প্রাণীকুলও অভিনয় করতে পারে।

প্রাণীজগতেও অনেক প্রাণীর মধ্যে বিশেষ একধরণের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, এমন কি তার অভনয় করতে জানেন।প্রয়োজনের তারা মৃতের অভিনয় করতে পারেন।এমন কিছু কিছু প্রাণীর কথা তুলে ধরা হলো।

মাকড়শা:

যৌনমিলনের পূর্বে কিংবা পরে সঙ্গীকে ভক্ষণ করার প্রথা পতঙ্গ জগতে বেশ সাধারণ ঘটনা। বিশেষ করে স্ত্রী পতঙ্গগুলো পুরুষ সঙ্গীদের খেয়ে ফেলে মিলনের সময়কালে কিংবা মিলনের ঠিক পরপরই। কিন্তু সবকিছুর উপরে তো নিজের জীবন, আবার বংশ তো বৃদ্ধি বা রক্ষাও করতে হবে। তাই জীবন বাঁচাতে পুরুষ পতঙ্গগুলো বেছে নেয় অভিনব পন্থা।ইউরোপিয়ান মেন্টিস (Mantis religiosa) প্রজাতির পুরুষরা যৌনমিলন শেষে একদম নিথর হয়ে যায়, স্ত্রী সঙ্গী যেন তাকে খেয়ে না ফেলে এই জন্যে ভুয়া মৃত্যুর অভিনয় করতে হয় তাদের।

একই বৈশিষ্ট্য হরহামেশা দেখা যায় মাকড়শাদের জগতেও। তবে একটু ভিন্ন ভাবে এবং দারুণ কৌশলী বৈশিষ্ট্য। নার্সারি ওয়েব মাকড়সা গোত্রের পুরুষেরা তাদের সম্ভাব্য সঙ্গীকে আগে একটি পতঙ্গ উপহার হিসেবে দেয়, যেন স্ত্রী সঙ্গী মিলনের সময় একটু নমনীয় থাকে। উপহার গ্রহণ করে পুরুষ সঙ্গীর দেওয়া পতঙ্গটি যদি স্ত্রী মাকড়সাটি খেতে শুরু করে, তাহলে পুরুষ মাকড়শাটি তার কাজ অব্যাহত রাখে। কিন্তু স্ত্রী মাকড়শা যদি পতঙ্গটি খাওয়া শুরু না করে, তাহলে সাথে সাথে পুরুষটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অভিনয় করে পড়ে থাকে। কিছু সময় পরে যদি স্ত্রী সঙ্গী উপহারটি গ্রহণ করে উদরপূর্তি শুরু করে, ঠিক তখনই যেন আবার জীবন ফিরে পায় পুরুষ মাকড়শাটি। এরপরই সাথে সাথে উদ্দেশ্য সাধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পুরুষ সঙ্গীটি।

অপোসাম:

আমেরিকান অপোসাম (Didelphis virginiana) আমেরিকার একধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা মূলত বৃক্ষজীবী। নিখুঁত মৃত্যুর অভিনয়কে তারা নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। পুরো প্রক্রিয়া এতটাই নিখুঁত যে, প্রাণীদের মারা যাওয়ার অভিনয়কে অনেক সময় ‘Playing possum’ নামেও অবহিত করা হয়। অপোসামদের জীবন যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন তারা দারুণ একটি অভিঘাত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। শুরুতে তাদের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস যথাসম্ভব কমে আসে, একপর্যায়ে তারা অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং মৃত দেহের মতো শরীর শক্ত হয়ে যায়। ব্যাহ্যিকভাবে এরকম একটি অপোসামকে দেখে মৃত বলেই মনে হয়।এতটুকু যথেষ্ট হলেও, পুরো ব্যাপারটিকে একদম নিখুঁত করতে প্রাণীগুলো আরও একটি কাজ করে। পায়ুপথ গ্রন্থি থেকে একধরনের তরল নির্গত করে অপোসামরা, যেটির গন্ধ একদম হুবহু প্রাণীদের মৃত দেহ থেকে আসা গন্ধের মতো। এই অবস্থায় তারা প্রায় টানা ৪ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। যেহেতু বেশিরভাগ শিকারী প্রাণী মৃত ও পচে যাওয়া দেহ এড়িয়ে চলে, সেহেতু অপোসামদের এই ভুয়া মৃত্যুর অভিনয় কতটা কাজের তা বলা বাহুল্য।

সাপ

অপোসামদের মতোই ইস্টার্ন হগনোস সাপ (Heterodon platirhinos) ও বেবি ব্রাউন সাপেরা (Storeria dekayi) দারুণ অভিনেতা। আসন্ন বিপদ কিংবা হুমকির মুখে যখন সাপগুলো তাদের আক্রমণাত্মক আচরণ যেমন ‘হিসহিস’ শব্দ বা ফণা তুলেও কাজ হয় না, তখন রক্ষণাত্মক পন্থা অবলম্বন করে ভুয়া মৃত্যুর ভান ধরে। শরীর উলটিয়ে আকাশের দিকে পেট দিয়ে শরীর শক্ত করে মরার মতো পড়ে থাকে, একই সাথে হা করে জিহ্বা বের করে প্রক্রিয়াটিকে আরও বাস্তবসম্মত করে তুলতে এদের জুড়ি নেই। অপোসামদের মতোই তখন ইস্টার্ন হগনোস সাপও একধরনের বিশ্রী গন্ধ ছড়ায়, যা তাদের আত্মরক্ষার প্রক্রিয়াকে আরও সুদৃঢ় করে।

পিঁপড়া

আক্রমণের শিকার হলে সক্ষমতা ভেদে Solenopsis invicta প্রজাতির পিঁপড়াদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ লক্ষ্য করা যায়। কয়েক সপ্তাহ বয়স্ক পিঁপড়া যাদের পাখা আছে, তারা উড়ে পালিয়ে যায়। কয়েক মাস বয়স্ক এবং শক্তিশালী পিঁপড়ারা আক্রমণ প্রতিহত করতে লড়াই করতে শুরু করে। কিন্তু মাত্র কিছুদিন বয়সের পিঁপড়া, যারা বলতে গেলে শিশু তাদের করার মতো কিছু করার থাকে না। এই পিঁপড়াগুলো উড়তেও পারে না, আবার লড়াইও করতে পারে না। তখন এই বাচ্চা পিঁপড়াগুলো Thanatosis এর উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ মারা যাওয়ার অভিনয় করে।

মাছ (Sleeper fish)

শুধুমাত্র আত্মরক্ষার তাগিদে শিকারির হাত থেকেই বাঁচতেই Thanatosis ব্যবহার করা হয় না, শিকার করতেও এটি একটি অসাধারণ কৌশল হিসেবে কাজ করে। Livingstoni cichlid প্রজাতির মাছগুলো শিকার ধরার কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে মরে যাওয়ার ছলনাকে। তাই তাদের ‘Sleeper fish’ নামেও ডাকা হয়। এই মাছগুলো তাদের বাসস্থানের তলদেশে একদম নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে শিকার কাছে আসার অপেক্ষায়। তাছাড়া এদের গায়ে বিশেষ কিছু দাগ রয়েছে যা দেখে মনে হয় যে, মাছটি মারা যাওয়ার পর গিয়ে পচন ধরেছে। সহজলভ্য খাবার ভেবে ছোট মাছেরা এগিয়ে যায় সেখানে। এই মাছগুলোর চেয়ে ছোট কোনো মাছ তাদের আওতার মধ্যে আসলেই আর রক্ষা নেই।

ট্রোজান হর্স

নিজেদের দুর্ভেদ্য শহরে কাঠের তৈরি বিশাল ঘোড়া প্রবেশ করানোর মধ্য দিয়েই ধ্বংস ডেকে এনেছিলো ট্রয় অধিবাসীরা, যা ট্রোজান হর্স নামে অধিক পরিচিত। Claviger testaceus নামের একধরনের পোকা খাদ্য যোগাড় করতে মৃতের মতো পড়ে থাকে। মৃত ও খাবার ভেবে পিঁপড়ার দল যখন তাদের ঘরে নিয়ে যায় পোকাটিকে, তখনই ট্রোজান হর্সের মতো আসল রূপ ধারণ করে পোকাটি। ঘরের ভিতরে প্রবেশ করার পর স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে আক্রমণ করে এবং পিঁপড়াদের লার্ভা খেয়ে সাবাড় করে দেয় পোকাটি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, শিকারি পরিণত হয় শিকারে।

হাঙ্গর:

হাঙ্গরের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচা তো সোজা কথা নয়। তবে কিছু বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, হাঙ্গর আক্রমণ করলে এর চোখের কাছাকাছি ঘুষি দেওয়া সম্ভব হলে, তারপর এটি নিবৃত হবে। হাঙ্গরদের মধ্যে লেমন শার্ক যথেষ্ট বড় ও শক্তিশালী হলেও এরা অনেকটা নম্র স্বভাবের। এই প্রজাতির হাঙ্গরদের পিছনে মৃদু টোকা দিলে তারা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় এবং বেশ খানিকটা সময় মরার অভিনয় করে। এই কারণেই হয়তো হাঙ্গরদের অন্য যেকোনো প্রজাতির চেয়ে এই হাঙ্গরগুলোর উপর সবচেয়ে বেশি গবেষণা করা সম্ভব হয়েছে।