‘আমি আর খারাপ কাজ করুম না, আমারে ধইরেন না’

২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর, সুস্থ অবস্থায় সৌদির আরবের রিয়াদে কাজের সন্ধানে যান জোহরা বেগম (ছদ্মনাম)। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাজ করে গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে ২৫-৩০ হাজার টাকা পাঠান তিনি। এ সময়ের মধ্যে কখনো কখনো তার ভাই ও একমাত্র মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হতো জোহরার। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় তার। দুশ্চিন্তায় পড়ে তার পরিবার।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ফিরেছেন সেই জোহরা বেগম। তবে সুস্থ অবস্থায় নয়। দেশে ফিরে কাউকেই চিনতে পারছেন না তিনি। কোনো ব্যক্তি তাকে ধরতে গেলে চিৎকার দিয়ে উঠছেন। নিজের একমাত্র মেয়েকেও চিনতে পারছেন না জোহরা।

জোহরার পরিবারের দাবি, সৌদিতে থাকাকালে তাকে এতটাই নির্যাতন করা হয়েছে যে, স্বাভাবিক বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন জোহরা। কেউ তার কাছে গেলেই চিৎকার দিয়ে বারবার একটি কথাই আওড়াচ্ছেন। আর তা হলো- ‘আমি আর খারাপ কাজ করুম না। আমারে ধইরেন না।’

গত ২১ মার্চ আমিরাত এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে রাত ৮টায় ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে ২৪ জন নারী সৌদি আরব থেকে ফেরেন বাংলাদেশে। এই নারীদের সবাই দেশটিতে গিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজে। কিন্তু কফিলদের (বাসার মালিকদের) খারাপ আচরণ, কথায় কথায় নির্যাতনসহ নানা কারণে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

জানা যায়, ওই সৌদিফেরত নারীদের মধ্যেই ছিলেন জোহরা বেগম। তিনি ওই বিমান থেকে নামলেও মানসিক ভারসাম্য না থাকায় ইমেগ্রেশন করতে পারেননি। থেকে যান বিমানবন্দরের রানওয়েতেই। এভাবেই পেরিয়ে গেছে ২৪ ঘণ্টারও বেশি। জোহরা ঘুরে বেড়ান রানওয়েতে! বিষয়টি অনেকের চোখে পড়লেও এড়িয়ে যান তারা।

২২ মার্চ, বৃহস্পতিবার রাত আটটায় বিমানবন্দরে কাজ করার সময় পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জোহরা বেগমকে আবিষ্কার করেন। জোহরাকে নিয়ে যান শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু জোহরা কিছুই বলতে পারছিলেন না। শুধুই চিৎকার আর অস্বাভাবিক আচরণ করছিলেন তিনি। অবস্থা দেখে বিপাকে পড়েন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার সঙ্গে থাকা পাসপোর্ট দেখে পরিচয় জানার চেষ্টা চলে। শাহজালাল কর্তৃপক্ষ ফোন করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ডেস্কে জানান, জোহরা নামের একজন নারী দেশে ফিরলেও এখনো ইমেগ্রেশন অতিক্রম করেননি।

পরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে কল করা হয় ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগে। সেখান তথ্য আসার পর ব্র্যাকের মাইগ্রেশনে কাজ করা ব্যক্তিরা ওই রাতেই জোহরা বেগমের নরসিংদীর বাড়ির খোঁজ নেওয়া শুরু করেন। একপর্যায়ে গ্রামে জোহরার আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ মেলে। সেই আত্মীয় জোহরার ভাইকে ফোন করে বিমানবন্দরের ঘটনাটি জানান। পরবর্তী সময়ে ২২ মার্চ রাত আড়াইটার দিকে স্বজনদের কাছে তুলে দেওয়া হয় জোহরা বেগমকে। এ সময় জোহরা স্বজনদের কাউকেই চিনতে পারছিলেন না।

জানা গেছে, জোহরা বেগমের গ্রামের বাড়ী নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায়। তার স্বামী বছর সাত আগে দুবাই যাওয়ার পর আর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন জোহরা। মেয়ের বয়স এখন ১২ বছর। প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল মেয়েটিকে মানুষের মতো মানুষ করার। সে জন্য প্রয়োজনীয় টাকা জোগার আর স্বচ্ছলতার খোঁজেই জোহরা পাড়ি জমান সৌদি আরবে।

জোহরা বেগমের ভাই লোকমান সরকার বলেন, ‘বইনটা দুইদিন থাইক্যা কিচ্চু খায় নাই। একটা দানাও মুখে দেয় নাই। কিচু কইতেও পারে না। তারা যে কি করাইছে কইতেও পারে না। বইনটা মনে হয় পাগলি হইয়া গেল। কিচ্ছু কইবার পায় না। ধইরতে গেলে কয়, আমারে ধইরবেন না।’

লোকমান জানান, জোহরাকে গ্রামের এক দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। তখন ওই দালাল তাদের জানিয়েছিল- সেখানে একটি বাসাবাড়িতে কাজ করবে। পাশাপাশি ওই বাসার বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসবে এবং বাসায় নিয়ে আসবে। সেই সময় তার সৌদি যেতে মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল।

জোহরার পরিবারের দাবি আল ফাইন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তিনি।

জোহরা সৌদি যাওয়ার সময় এই পুরো টাকাই তারা জমিজমা বিক্রি করে সংগ্রহ করেছিলেন। এখন তার বোনকে ভালো চিকিৎসক দেখানোর টাকাটাও তাদের কাছে নেই বলে জানান জোহরা বেগমের ভাই লোকমান সরকার।

জোহরা বেগমকে তার স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগ। এই বিভাগের তথ্য কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন বলেন, ‘বিমানবন্দরে নেমেই সেখানে এক রাতসহ পরদিন ছিলেন জোহরা। কিন্তু কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। পরদিন রাতে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু সে এতোটাই পাগলি যে, কেউ তাকে ধরতে পারছিল না। কোনো পুরুষ তার কাছে গেলেই সে রেগে চিৎকার করে বলছিল- ‘আমি আর খারাপ কাজ করুম না। আমারে ধরবেন না।’

জোহরা এখন তার পরিবারের কাছে আছেন। খুব শিগগিরই তার চিকিৎসার জন্য কাউন্সিলিং শুরু করা হবে। তার মাঝে প্রচণ্ড ট্রমা ছিল। কোনো পুরুষ মানুষ দেখলেই জোহরা এখন রেগে ওঠেন বলে জানান ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা।

জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল এলাকার ১০৫ ফকিরাপুল এলাকার মালেক ম্যানশনের (প্রথম তলা) ঠিকানায় থাকা আল ফাইন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস নামের একটি এজেন্সির মাধ্যমে জোহরা সৌদিতে যান। মো. আব্দুল কাইয়ুম আব্বাসী নামের এক ব্যক্তি ওই এজেন্সির মালিক।

আল ফাইন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক আব্দুল কাইয়ুমকে পক্ষ থেকে বার বার ফোন করা হলেও তা রিসিভ হয়নি।

শুধু জোহরা বেগমই নন, তার মতোই ওইদিনই ফরিদপুর কোতয়ালী থানার আরও একজন নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন। অবশ্য ওই নারী অপর এক নারীর সহায়তায় বিমানবন্দরের ইমেগ্রেশন বিভাগ অতিক্রম করে বাইরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে জানান ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের কর্মীরা।
প্রিয়