স্বামী স্ত্রীর তালাকের জন্য যা করল গ্রাম্য প্রধানরা

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোয়াড়ী ইউনিয়নের নওপাড়া গ্রামে শুধুমাত্র প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে কথা বলার অপরাধে গ্রাম্য সালিশে স্বামী-স্ত্রীকে তালাকে বাধ্য করেছেন গ্রাম প্রধানরা। এর আগে গভীর রাতে গৃহবধূ রুনা খাতুনকে কথিত প্রেমিকের বাড়িতে তুলেও দিয়ে আসেন তারা। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে ওই গৃহবধূ সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে কিছু বললে বা মামলা করলে একঘরে করে দেয়াসহ প্রয়োজনে গ্রামছাড়া করারও হুমকি দিচ্ছেন ওইসব প্রধানরা। প্রধানদের হুমকির মুখে বর্তমানে বাড়িতে এক প্রকার অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন তারা।

গৃহবধূ রুনা খাতুন ও তার বাবা আব্দুর রহমানসহ স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এ সময় গ্রাম প্রধান ইউনুস আলী লোকজন নিয়ে রুনার বাবার বাড়িতে এসে সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাসহ তাদের সামনেই হুমকির মুখে রুনা ও তার বাবাকে বাড়ির ভেতরে যেতে বাধ্য করেন। এছাড়া সাংবাদিকসহ কারো সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো কথা বললে তাদেরকে একঘরে করারও হুমকি দেন তারা।

এ সময় গ্রাম প্রধান ইউনুস আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রামে আমরাই কোর্ট, আমরাই আদালত। আমরা যে রায় দিয়েছি সেটাই চূড়ান্ত। এ ব্যাপারে কোনো সাংবাদিক কোনো সাক্ষাৎকার নিতে পারবে না। এ সময় রুনা ও আলমগীরের পরকীয়া সম্পর্কের প্রমাণ চাইলে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

এলাকাবাসী জানান, গত শুক্রবার সকালে নওপাড়া গ্রামের আলমের স্ত্রী রুনা খাতুন তার চাচা শ্বশুরের বাড়িতে মোবাইলে চার্জ দিতে যায়। এ সময় প্রতিবেশী কলেজছাত্র আলমগীরের সঙ্গে দেখা হলে তিনি সৌজন্যমূলক কথা বলে চলে আসেন। পরে প্রতিবেশী কয়েকজন লোক সেখানে তারা অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল বলে দাবি করে সন্ধ্যায় সালিশ বসান। সালিশে এক তরফাভাবে রুনা খাতুনকে দায়ী করে কলেজছাত্র আলমগীরের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হবে বলে জানানো হয়। সালিশ শেষে রাত ২টার দিকে গ্রাম্য প্রধানরা চাপের মুখে রুনাকে আলমগীরের বাড়িতে তুলে দিয়ে আসেন।

শনিবার সন্ধ্যায় গ্রাম্য প্রধানরা আলমগীরের বাড়ি থেকে রুনাকে মিমাংসা করা হবে বলে ডেকে এনে দ্বিতীয় দফা সালিশ বসান। সালিশে স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল ওয়াহাব ও আব্দুল গফুর, গ্রাম প্রধান ইউনুস আলী, চাঁদ মিয়া, আবু সাঈদ উপস্থিত ছিলেন। সালিশে রুনার বাবা ভ্যানচালক আব্দুর রহমানকে একা ডেকে নিয়ে যান তারা। পরে কাজী ডেকে এনে হুমকির মুখে স্বামী আলম ও স্ত্রী রুনা খাতুনকে খোলা তালাকে বাধ্য করেন। একইসঙ্গে কলেজ ছাত্র আলমগীরের সঙ্গে আগামী সাতদিনের মধ্যে রুনার বিয়ে দেয়া হবে মর্মে আলমগীরের বাবা আব্দুল আজিজকে দিয়ে জোরপূর্বক লিখিত আদায় করেন। সালিশ শেষে রুনাকে এক কাপড়ে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

এদিকে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপ-পরিদর্শক তহসেনুজ্জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম নওপাড়া গ্রামে ওই গৃহবধূর বাড়িতে যায়। এ সময় পুলিশ থানায় এনে মামলা করানোর কথা বললে গৃহবধূ রুনা খাতুন রাজী হন। কিন্তু গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হবে বলে প্রধানদের দেয়া হুমকির কারণে রুনার বাবা আব্দুর রহমান তাকে থানায় যেতে নিষেধ করেন।

এরআগে কয়েকজন সাংবাদিক ওই বাড়িটিতে গেলে কয়েকজন গ্রাম প্রধান ও তাদের লোকজন বাড়িটির সামনে অবস্থান নেয়। এ সময় তারা প্রকাশ্যেই তাদেরকে বাড়ি থেকে বের না হওয়ার নির্দেশ দেয় এবং বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে বলেও হুমকি দেয়। তাদের হুমকির কারণে নির্যাতিত পরিবারটির কোনো সদস্যই বাড়ি থেকে বের হয়ে কথা বলার সাহস করেনি।

রুনার বাবা আব্দুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, কপালে যা ছিলো তাই হয়েছে। পুলিশ তো আর প্রতিদিন আমাকে পাহারা দেবে না। এক মেয়ে নিয়ে লড়তে গিয়ে শেষে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারাতে চাই না।

বড়াইগ্রাম থানার ওসি শাহরিয়ার খান জানান, এ ব্যাপারে আমরা যথেষ্ঠ আন্তরিক। তাদের নিরাপত্তাসহ বিষয়টি নিয়ে কী করা যায় সে ব্যাপারে তৎপর আছি।