আজ ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ভাগ্যে কি আছে ?

‘ওয়ানডের তুলনায় টাইগাররা টি-টোয়েন্টি কম পারে।’ অতি সংক্ষেপে বা মোটা দাগে ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে সেটাই বাংলাদেশের যথাযথ মূল্যায়ন। ওয়ানডের তুলনায় টি-টোয়েন্টিতে টাইগারদের জয়ের অনুপাত সত্যিই কম।

এছাড়া পারফরম্যান্সও তত উজ্জ্বল নয়। তাই সমালোচকরা সরব। তাদের কথা, আসলে বাংলাদেশ এখনো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা ঠিক আত্মস্থ করতে পারেনি। ২০ ওভারের ম্যাচ জিততে করণীয় এখনো সে ভাবে শিখে উঠতে পারেনি টাইগাররা।

পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা থাকলে আর মাঝে মধ্যে একে ওকে হারালে, কিছু দিন পর পর রাঘব বোয়াল শিকার করলে, এমন তীর্যক কথা শুনতে হতো না। কিন্তু ইতিহাসও জানান দিচ্ছে, টি-টোয়েন্টিতে ততটা উজ্জ্বল নয় টাইগারদের পারফরম্যান্স।

এখন পর্যন্ত ৭৩ ম্যাচে জয় মোটে ২২ টি। যার ১০ টি আবার আইসিসির সহযোগি সদস্য কেনিয়া (এক খেলায় একটি), আফগানিস্তান (এক ম্যাচে এক জয়), নেপাল (এক খেলায় এক জয়), আয়ারল্যান্ড (৫ খেলায় ৩ জয়), নেদারল্যান্ডস (৩ খেলায় ২ জয়), ওমান (এক খেলায় এক জয় ), আরব আমিরাতের (এক খেলায় এক জয়) বিপক্ষে।

এই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এখন পর্যন্ত আইসিসির অপর দুই সহযোগি সদস্য হংকং (এক খেলায় এক হার) ও স্কটল্যান্ডের (এক ম্যাচে এক হার) সাথে জয়ের দেখা পায়নি টাইগাররা। বাকি ১২ জয়ের ৫টি আবার র্যাঙ্কিংয়ে সবার পিছনে থাকা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

জিম্বাবুয়ে ছাড়া ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর মধ্যে এখন অবধি শুধু পাকিস্তান (১০ খেলায় ২ জয়) , ওয়েস্ট ইন্ডিজ (৬ খেলায় ২ জয়) আর শ্রীলঙ্কার (১০ খেলায় ৩ জয়) বিপক্ষেই কেবল জয়ের রেকর্ড আছে। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া (৪ ম্যাচে সবগুলোতেই হার), ভারত (৬ খেলায় প্রতিটাতেই হার), নিউজিল্যান্ড (৭ খেলায় সবকটায় হার) ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে (৬ খেলার সবগুলোয় হার) এখনো জয়ের দেখা মেলেনি। ‘সোনার হরিণ’ হয়েই আছে।

তাই বলে যে , টাইগারদের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট খেলার সামর্থ্য তৈরি হয়নি, কিংবা আগে কখনো ছিল না- তা বলাও বোধ করি ঠিক হবে না। ইতিহাস জানাচ্ছে, বাংলাদেশ আগেও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বড় ম্যাচ জিতেছে।

২০০৬ সালে প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলতে শুরু করা বাংলাদশ প্রথম বড় জয় পায় ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে, বিশ্ব টি-টোয়েন্টির বড় মঞ্চে। তাও যেনতেন দলের বিপক্ষে নয়। ক্রিস গেইল, শিবনারায়ণ চন্দরপল, মারলন স্যামুয়েলস, রামনরেশ সারওয়ান, দিনেশ রামদিন, ডোয়াইন স্মিথ, ডোয়াইন ব্রাভো, রিকার্ডো পাওয়েল আর ফিল অ্যাডওয়ার্ডসের মত নামি ও প্রতিষ্ঠিত তারকাদের বিপক্ষে। শক্তিশালি এই ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই ৪ উইকেটে হারিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন আফতাব-আশরাফুলরা।

আফতাব ৪৯ বলে অপরাজিত ৬২ (৮ বাউন্ডারি ও ১ ছক্কা) আর আশরাফুল ২৭ বলে ৬১ (৭ বাউন্ডারি আর ৩ ছক্কা) জুটির ১০৯ রানের জুটিতে ক্যারিবীয়দের ১৬৪ রান টপকে ১২ বল আগেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ।

এরপর তিন বছর আগে দেশের মাটিতে পাকিস্তানকে হারিয়ে টাইগাররা জানান দেয়, আমরাও পারি। আর গত বছর শ্রীলঙ্কার মাটিতে লঙ্কানদের বিপক্ষে ৪৫ রানের জয়টিও সামর্থ্যের প্রামাণ্য দলিল।

তারপরও সামগ্রিকভাবে জয় সংখ্যা খুব কম। ধারাবাহিকতা আরও কম। তাই সমালোচকরা বড় মুখ করে বলেন, ‘টি-টোয়েন্টি পারে না বাংলাদেশ।’ এই ‘পারেনা’ কথাটি আসলে সত্য নয়। একদমই পারে না, ঠিক নয়। পারে। তবে খুব কম। হঠাৎ- হঠাৎ বা কালে-ভদ্রে।

সবার জানা, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই চার-ছক্কার অবাধ প্রদর্শনী। একটা মার মার কাট অবস্থা। যেখানে বাহারি মার, আক্রমণাত্মক উইলোবাজি আর বাহারি স্ট্রোক প্লে ও বিগ হিটই শেষ কথা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এর সবগুলোই করেন ব্যাটসম্যানরা। তাই টি -টোয়েন্টিকে ‘ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি’ ফরম্যাট বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। যেহেতু মাত্র ১২০ বলের খেলা, তাই অল আউট হওয়া বা করা কঠিন। সে কারণেই বোলারদের ম্যাচ নির্ধারণী ভূমিকা নেবার সুযোগও কম।

তারওপর বেশির ভাগ টি-টোয়েন্টি আসরই হয় শতভাগ ব্যাটিং সহায় পিচে। যেখানে বোলারদের তেমন কিছু করারও থাকে না। এই যেমন নিদাহাস ট্রফির কথাই ধরা যাক। কলম্বোর প্রেমদাসা স্টেডিয়ামের যে উইকেটে খেলা হচ্ছে, তা শতভাগ ব্যাটিং উপযোগি। তাই তো শ্রীলঙ্কার ২১৪ রানও যথেষ্ট মনে হয়নি। টাইগাররা সেই রান অতিক্রম করেছে বীরের মত।

মুশফিকের ব্যাটে ছিল উত্তাল রূপ। লিটন দাস আর তামিমও টি-টোয়েন্টির লাগসই ব্যাটিংই করেছেন। খালি চোখে মনে হচ্ছে ওই তিনজন (তামিম ১৬২ .০৬ স্ট্রাইকরেটে ৪৭, লিটন দাস ২২৬.৩১ স্ট্রাইকরেটে ৪৩ আর মুশফিক ২০৫.৭১ স্ট্রাইকরেটে ৭২ অপরাজিত) হাত খুলে খেলেছেন বলেই জিতেছে বাংলাদেশ।

তা অবশ্যই। তবে শুধু হাত খুলে খেলা আর স্ট্রাইকরেট বেশি থাকার কারণেই নয়, আসলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটিংটা হয়েছে একদমই টি-টোয়েন্টি উপযোগি। দুই ওপেনার ঝড়ের গতিতে ওভার পিছু ১২ রানের বেশি (৫.৫ ওভারে ৭৪ রান) তুলে লঙ্কান বোলিংকে এলোমেলো করে দলকে শক্ত ভীত গড়ে দেন।

সেই ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে মুশফিক শুরু করেন। আর ম্যাচ শেষ করেই সাজঘরে ফেরেন। অর্থাৎ ওপরের দিকে দুজনার বেশি ভালো খেলা আর মাঝখানে একজন হাল ধরে দল জিতিয়ে ফিরিয়ে আসা-এটাই টি-টোয়েন্টির আদর্শ ব্যাটিং। এমন সাজানো গোছানো ব্যাটিং পারফরম্যান্স হলে সেই দলকে আটকে রাখা কঠিন।

আর ভারতের বর্তমান দলটির বোলিং এমন আহামরি নয়। শ্রীলঙ্কার মতই। তবে ভারতীয়রা আইপিএল খেলে খেলে কম বেশি সবাই পরিণত। ছন্দ ফিরে পাওয়া ব্যাটসম্যানকেও কিভাবে বশ করা যায়, তা ভারতীয় বোলারদের ভালোই জানা।

তারপরও ঘুরেফিরে হিসেব নিকেশ একটাই- ওপরে আর মাঝ খানে অন্তত দুই জনকে বড় ইনিংস খেলতেই হবে। সেটা আগের ম্যাচের মত তামিম, লিটন আর মুশফিককেই অমন ভূমিকা নিতে হবে -তা নয়। সৌম্য, মাহমুদউল্লাহ আর আরিফুলের (সাব্বিরের বদলে হয়তো কাল তাকেই খেলানো হতে পারে) যে কোন দুজনকে দায়িত্ব নিতেই হবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তামিম, লিটন আর মুশফিক যেমন বুক চিতিয়ে আর অংক কষে খেলেছেন, ঠিক তেমন হিসেবি ব্যাটিংটাই দরকার।

আর সাথে বোলারদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। প্রতি ম্যাচে ২১৪ রান অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এ কঠিন সত্য মাথায় রেখে বল করতেই হবে। ভুলে গেলে চলবে না, কোহলি-ধোনি আর পান্ডিয়ার মত আক্রমনাত্মক উইলোবাজ না থাকলেও ভারতীয় দলে রোহিত শর্মা আর শেখর ধাওয়ানের মত বিধ্বংসী ওপেনার আছেন।

রোহিত শর্মার উত্তাল ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। যিনি ৫০ ওভারের ম্যাচে তিন তিনবার ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেন, তার সামর্থ্য যে প্রমাণিত। বাঁহাতি শিখর ধাওয়ান ও কম যান না। নিজের দিনে তারও আছে প্রতিপক্ষ বোলিং দুমড়ে মুচড়ে দেবার ক্ষমতা। এর বাইরে লোকেশ রাহুল আছেন। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এ মুহূর্তে যার গড় প্রায় পঞ্চাশ (১৩ খেলায় ১২ ইনিংসে এক সেঞ্চুরি আর তিন হাফ সেঞ্চুরিতে ৪৭.৬০ গড়ে ৪৭৬ রান)।

এদের বিপক্ষে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করতেই হবে। হয়তো আগের ম্যাচে আলগা বোলিংয়ের কারণে তাসকিন আহমেদের এ ম্যাচ নাও খেলা হতে পারে। তার জায়গায় আবু জায়েদ রাহির সম্ভাবনাই হয়তো বেশি থাকবে। তবে যেই খেলুন না কেন, বাংলাদেশের বোলিং আরও টাইট হতেই হবে।

ভারতীয়দের ফ্রি খেলতে দিলে কিন্তু বিপদ। রান আবার ২০০ হয়ে যেতে পারে। আর বার বার দু‘শো টপকে জেতা কিন্তু সহজ নয়। বোলাররা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের ১৭০/১৮০’র ঘরে আটকে রাখতে পারলে হিসেবটা সহজ হবে।