আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস

আজ ২৬ মার্চ। আজ দেশের ৪৭তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। এ বছর আমাদের মহান স্বাধীনতার ৪৭ বছর পদার্পণের শুভ মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন বিশেষ মাত্রা যোগ হয়েছে। একই সঙ্গে গত বছরের অক্টোবরে একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া সেই কালজয়ী ভাষণও ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্যর স্বীকৃতি লাভ করে।

জাতি আজ বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছে স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী দেশের বীর সন্তানদের। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে স্বাধীনতার রূপকার বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।তোমাদের এর ঋণ শোধ হবে না। এ ঋণ শোধ হবার নয়। কারণ তোমরাই দিয়ে গেছো এ দেশে। বিশ্বের বুকে এ জাতির পরিচয়।

মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষে এবার জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধারা, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাধারণ জনগণ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এবারই প্রথম স্বাধীনতা দিবসের দিন সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জাতীয় শিশু কিশোর সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সারাদেশে ও বিদেশে একযোগে একই সময়ে শুদ্ধসুরে জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্দ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে যে বিভীষিকাময় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল- দীর্ঘ নয় মাসে মরণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলার দামাল সন্তানেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সে যুদ্ধে বিজয় লাভ করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে।

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তনি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকজনের নির্বিচারে গণহত্যা করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্প কলা একাডেমি , শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করবে। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রমসহ এ ধরনের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং রাতে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো।

দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে।

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। এদিন রাজধানীর সড়ক ও সড়কদ্বীপ জাতীয় পতাকাসহ নানা রঙের পতাকা দিয়ে সাজানো হবে।

মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দুই দিনব্যাপী বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোরে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৬টায় সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ও সকাল ১১টায় টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।

এ ছাড়া আগামীকাল ২৭ মার্চ বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন।

মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন যুব ও ছাত্র সংগঠন মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১৯৭১ সালের এ দিন থেকে শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ৪৭ তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন করছে জাতি। এ বছর আমাদের মহান স্বাধীনতার ৪৭ বছর পদার্পণের শুভ মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন বিশেষ মাত্রা যোগ হয়েছে।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির ওপর (পূর্ব পাকিস্তানের) যে শোষণ এবং আগ্রাসন চালিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধিকারের আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছিলেন বাঙালিরা। দেশ বিভাগের পর থেকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য তৈরি করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। বাঙালিকে বার বার চেষ্টা করেছে ধাবিয়ে রাখতে। তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে। কিন্তু অধিকার আদায়ে কোনো ছাড় দেয়নি এ জাতি।

সবশেষ বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করে দিতে পাকিস্তানিরা মেতে ওঠে হত্যাযজ্ঞে। এর চূড়ান্ত আঘাতহানে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় বাঙালি হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। গভীর রাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে বন্দি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

এর আগেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ইপিআরের (বর্তমানে বিজিবি) ওয়্যারলেস থেকে তার এই ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল।

৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ৫৬’র সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ৫৮’র আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬’র বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার আন্দোলন, ৬৯’র রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানের পথ পেরিয়ে ৭০’র ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সবই বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের একেকটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলক।

এরপর ৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালিকে মুক্তির পথ দেখায়। জাতি দেখতে পায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপরেখা। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকহানাদার বাহিনী। নির্বিচারে হত্যা করে সাধারণ মানুষদের।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দির পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে বাঙালির চূড়ান্ত মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে, অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মধ্যদিয়ে বিশ্বের বুকে স্থান পায় একটি দেশ, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা। এ আমার বাংলাদেশ।

এ বছর আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জাতি এমন একটি প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে যেখানে একাত্তরে সেই পরাজিত শক্তি, প্রথম কাতারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে।