বউ বিক্রি

সিমোন ও’কানে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের বাসিন্দা। ৩৩ বছরের সিমোন পেশায় টেলিকম ইঞ্জিনিয়ার। তার স্ত্রী লিয়েন্ড্রা। স্ত্রীর একটি ছবি দিয়ে সঙ্গে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে একটি অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেন সিমোন। বিজ্ঞাপনটির হেডলাইন ছিল এ রকম, ‘ব্যবহৃত স্ত্রী বিক্রি হবে’। পাশাপাশি স্ত্রীর সম্পর্কে বিশদ বিবরণ, যেমন- তার ভাল ও খারাপ গুণ, কেন বিক্রি করতে চাইছেন সবই লিখে দেন তিনি। এছাড়া বিক্রিত স্ত্রীকে আর ফেরত নেওয়া হবে না, সে শর্তও স্পষ্ট করে লিখে দেন সিমোন।

সিমোনের পূর্বপুরুষরাও প্রায় দেড়শ বছর আগে বউ বিক্রি করতেন। ব্রিটিশ লেখক টমাস হার্ডির উপন্যাস ‘দ্য মেয়র অফ ক্যাস্টারব্রিজ’ এ বউ বিক্রির কথা উল্লেখ আছে। ক্যাস্টারব্রিজ একটা ফিকশনাল টাউন। এর মাঝেই উপন্যাসের গল্প। এই উপন্যাসের নায়ক মাইকেল হেনচার্ড তার বউকে নিলামে বিক্রি করে দেন। বিক্রির পর এই বিষয়টিই তাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। একসময় পাগল হয়ে মারা যান হেনচার্ড।

টমাস হার্ডির লেখায় যেমন বউ নিলামে বিক্রির বিষয় ছিল, এমন প্রথা চালু ছিল ইংল্যান্ডেও। এই প্রথার উৎপত্তি ১৭ শতকের শেষের দিকে। বউ তালাকের পদ্ধতি তখন ছিল জটিল ও ব্যয়বহুল। শুধু ধনী ব্যক্তিদের পক্ষেই সেই টাকা খরচ করে বিবাহ বিচ্ছেদে করার সামর্থ্য ছিল। বিয়ে করতেও যেমনি প্রচুর টাকা লাগতো, বিচ্ছেদেও তেমনি। এমন পরিস্থিতিতে পয়সাহীনেরা চালু করলেন নিলামে বউ বিক্রির পদ্বতি।

যখন বিবাহ টেকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠত, তখন বউ বিক্রি ছিল তাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত। তখন বউদের গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো বাজারে। বাজারে বউ কেনার জন্য এক শ্রেণির ক্রেতা ছিল। নিলাম শুরু হলে বউ বিক্রেতাকে সবাই ঘিরে ধরতো! নানা মাত্রার দাম হাঁকাহাঁকি পর এক পর্যায়ে বউ বিক্রি হয়ে যেতো। বিক্রি হবার পর নিলাম বিজয়ী ক্রেতার হাতে স্ত্রীর গলায় বাঁধা দড়ি তুলে দেওয়া হতো।

অনেক সময় বিক্রি ক্ষেত্রে বউয়ের সম্মতি থাকতো বলে শোনা যায়। কারণ বিবাহ বিচ্ছেদ তারও কাম্য ছিল। তবে জানা যায়, বিক্রিতে বউয়ের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল। তিনি বলতে পারতন, ‘আমি বিক্রি হবো না’! বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর ক্রেতা বউ নিয়ে চলে যেতো। মাঝে মাঝে ক্রেতা বিক্রেতা জামাইয়ের কাছ থেকে লিখিত নিতেন যে, ভবিষ্যতে সে যেন তার সাবেক বউয়ের দিকে চোখ তুলে না তাকায়। অর্থাৎ পুনরায় অধিকার দাবী না করে।

এসব ক্রেতা কারা ছিল? স্বাভাবিকভাবেই যাদের জন্য সাধারণ বিয়ে করা সহজ ছিল না। দেখতে অসুন্দর কিংবা বুড়ো লোক। ধনী লোকেরাও কিনতে আসতেন। তারা সরাসরি আসতেন না। তাদের অনুগতদের পাঠিয়ে কিনে নিতেন। ১৯১৩ সালে সর্বশেষ বউ নিলামে বিক্রির খবর পাওয়া যায়। আইনি প্রক্রিয়ায় তালাকের জটিলতা ও ব্যয় বেড়ে যায়। এ কারণে এমন অমানবিক সামাজিক প্রথার উদ্ভব ঘটে। বউ বিক্রির প্রথা ইংল্যান্ডে ছিল প্রয়োজন। অর্থাৎ যার টাকা নাই অথচ তালাকের প্রয়োজন, তারা বাধ্য হয়ে এই পদ্বতি গ্রহণ করতো। এছাড়া আইনি প্রক্রিয়ায় ১৫৭ বছরে মাত্র ৩৩৮ টি বিচ্ছেদ কার্যকর হয়। যার কারণে স্থানীয় হাটগুলোতে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বউ বিক্রি হতো। পূর্বপুরুষ সেই প্রথার ধারাবাহিকতায় হয়তো সিমোন বউ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। বিবরণের মধ্যে ভগবানের কাছে তার কাতর মিনতিও ছিল, ‘হে ঈশ্বর, প্লিজ কেউ যেন তাকে পছন্দ করে নেন।’

কিন্তু কেন এমন কাণ্ড ঘটালেন সিমোন? অভিযোগ, স্ত্রীর জ্বালায় নাকি ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তিতে থাকতে পারেন না। অফিস থেকে রোজ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন। আর বাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লিয়েন্ড্রা চিৎকার জুড়ে দিতেন। যে কোনও ছোটখাটো বিষয় নিয়েই চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দেন। দিন কয়েক আগেও এমন ঘটনার পর ভয়ঙ্কর বিরক্তিতেই নাকি এই কুবুদ্ধিটা মাথায় খেলে। দেরি না করে অনলাইন কেনাবেচার সাইটে বউ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে দেন।

ইতোমধ্যেই বিজ্ঞাপনটি নজরে পড়ে যায় অনলাইন সংস্থাটির। সঙ্গে সঙ্গে বাদ দিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। স্বামীর এই কীর্তিতে কর্মক্ষেত্রে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় লিয়েন্ড্রাকে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত, দুই সন্তানের মা, লিয়েন্ড্রা বলেছেন, ‘আমাকে শুধু বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছে তা-ই নয়, আমার খুব বাজে একটা ছবিও আপলোড করেছে। ওকে আমার খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছিল।’ আর এত কাণ্ড ঘটালেন যিনি, সেই সিমোনের বক্তব্য, নেহায়েত মজা করেই তিনি নাকি এসব করেছেন।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা ও অল দ্যাট ইন্টারেস্টিং ডটকম