মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে চাকরি নিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী

মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় কনস্টেবল থাকাকালীন ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় কর্মরত এএসআই আলম সরোয়ার্দি রুবেল।

প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ পিস ইয়াবা লাগত তার। কর্তব্যরত অবস্থায় টহল গাড়িতেও করতেন ইয়াবা সেবন। ধীরে ধীরে ইয়াবাসেবী থেকে পুরোদমে ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন রুবেল। গোটা থানা এলাকায়ই গড়ে তোলেন শক্তিশালী ইয়াবার সিন্ডিকেট। সেইসঙ্গে নিজের বাসাকেও বানিয়ে ফেলেছিলেন মাদকের মোকাম।

গত বুধবার গভীর রাতে রুবেলকে গ্রেফতারের পর তার বাসা ও কর্মস্থল থেকে নগদ টাকাসহ ৪৯ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়।

এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের এসআই মো. মাসুদ রানা বাদী হয়ে রুবেল ও জিম্মি দশা থেকে মুক্তিপণের ৫ লাখ টাকা দিয়ে ফিরে আসা সাবিনা আক্তার রুনুসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি মামলা করেছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশের চাকরি নিয়ে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন পুলিশের এএসআই আলম সরোয়ার্দি রুবেল। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে রুবেল পুলিশের চাকরি নিয়ে মাদকের রাজ্য গড়ে তুলেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

এদিকে, পুলিশের এএসআই আলম সরোয়ার্দি রুবেল কীভাবে মাদক ব্যবসায়ী হলেন এ নিয়ে জেলা পুলিশের মাঝে ব্যাপক আলোচনা চলছে। যেখানে একজন পুলিশ মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কথা ছিল সেখানে রুবেল মাদক ব্যবসায় কেন জড়ালেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

জানা গেছে, রুবেল মুন্সীগঞ্জ সদর থানায় কনস্টেবল থাকাকালীন ইয়াবায় আসক্ত হন। ডিউটিরত অবস্থায় বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন। মাদক সেবনকারীদের সঙ্গে একত্রে বসে ইয়াবা সেবন করতেন তিনি।

একপর্যায়ে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেখানকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী আবুলের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবুল প্রতিদিন তাকে ৩০-৪০ পিস ইয়াবা দিতেন। আবুলের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হলে তার বাড়িতে আসা যাওয়া শুরু হয় রুবেলের।

এর মধ্যে প্রথম স্ত্রীকে বাদ দিয়ে মাদক ব্যবসায়ী আবুলের মেয়েকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন রুবেল। এরপর মুন্সীগঞ্জ থানার একটি মামলার সূত্র ধরে রুবেলের সঙ্গে মুন্সীগঞ্জ পঞ্চসার এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম আরিফ ওরফে বাবা আরিফের পরিচয় হয়। তার সঙ্গে পরিচয়ে রুবেল মাদকসেবী থেকে হয়ে ওঠেন মাদক ব্যবসায়ী। একপর্যায়ে আরিফের স্ত্রী সাবিনা আক্তার রুনুর প্রতি নজর পড়ে রুবেলের। জড়িয়ে পড়েন পরকীয়ায়।

পরকীয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে রুবেল ও আরিফ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে কনস্টেবল থেকে এএসআই হিসেবে পদোন্নতি পান রুবেল। পরে মুন্সীগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার মদনগঞ্জ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন। সেখানেও মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তার বাসায় জমে মাদক ব্যবসায়ীদের আড্ডা। বিষয়টি জানতে পারে এলাকাবাসী। গত ৬ মাস আগে বন্দর থেকে বদলি হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় যান। সেখান থেকেও মুন্সীগঞ্জ ও বন্দরে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতেন রুবেল।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জে মালিরপাথর এলাকায় কারেন্ট জাল ভর্তি একটি ট্রাকে ডাকাতি করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হন মুন্সীগঞ্জের সেই আরিফ। উত্তেজিত জনতা সেদিন উপড়ে ফেলে তার এক চোখ। সেই থেকে চিকিৎসাধীন আরিফ। এ সুযোগে ঘরে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রেখে আরিফের স্ত্রী রুনুর সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক নতুন করে ঝালাই করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন রুবেল।

হাসপাতালে থাকা স্বামীকে দেখতে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জে রুনুকে পেয়ে যান এএসআই রুবেল। তখন রুবেল রুনুকে তার ফ্ল্যাটে নিতে চায়। রুবেলের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রুনুকে আটকে থানায় না নিয়ে বন্দর থানাধীন রূপালী আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসার দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যান রুবেল। মাদক মামলা দেয়া ছাড়াও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। রুনু মুন্সীগঞ্জে তার বাড়িতে টাকার জন্য ফোন দিলে ছোট বোন লীমা নিজের স্বর্ণালঙ্কার বন্ধক রেখে ৫ লাখ টাকা রুবেলের হাতে তুলে দিয়ে বোনকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। মুক্তিপণের পুরো ঘটনার মধ্যস্থতা করেন এএসআই রুবেলের সোর্স মোর্শেদ।

জিম্মিদশা থেকে ছাড়া পেয়ে পুলিশের এক ডিআইজিকে ঘটনার বিস্তারিত জানায় রুনু ও লিমা। ডিআইজি বিষয়টি অবহিত করেন আইজিপি মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীকে।

পরে রুবেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন জেলা পুলিশকে। পরিকল্পনাসহ রুবেলের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় ত্রিমুখী অভিযান।

বুধবার গভীর রাতে রুবেলের বাসায় অভিযান চালিয়ে ৪৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভেতর থেকে আরও ৫ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশের এসআই মাসুদ রানা বাদী হয়ে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন।