যে কারণে বাংলাদেশকে যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে মিয়ানমার!

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিপীড়িত হওয়ার শুরু থেকেই পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এরপর থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে মাইন পুঁতে রেখে রোহিঙ্গাদের পথরোধের চেষ্টা করছে দেশটির সেনাবাহিনী। এছাড়া কয়েকবার দেশটির সামরিক হেলিকপ্টার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে মিয়ানমারের কয়েকজন নাগরিক আটক হয়েছেন, সীমান্তে ভারী অস্ত্র নিয়ে টহল দিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এসব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ফেসবুক থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত সকলের মুখেই একটি প্রশ্ন; মিয়ানমার কি বাংলাদেশকে যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে? সাধারণের মনে এমন প্রশ্নে হ্যাঁ সূচক উত্তর আসলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধ নয় বরং বাংলাদেশকে উস্কানি দিয়ে সীমান্তে ঝামেলার সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও গণমাধ্যমের আড়াল করতে চায় মিয়ানমার।

চলতি বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের একটি সামরিক চেক পোস্টে হামলার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এরপর থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত প্রায় চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রবেশে করেছে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কোনোভাবেই তাদের গতিরোধ না করলেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেশটির সীমান্তে মাইন পুঁতে রেখে রোহিঙ্গাদের গতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। মাইন পুঁতে রাখার অভিযোগ মিয়ানমার প্রথমে অস্বীকার করলেও এখন প্রকাশ্যেই সীমান্তে মাইন পুঁতছে। শনিবার খোদ সময় টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে দেশটির সামরিক বাহিনীর মাইন পোঁতার দৃশ্য।

এছাড়া ২৫ আগস্টের পর থেকে বেশ কয়েকবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে দেশটির সামরিক হেলিকপ্টার, সীমান্ত অতিক্রম করেছে ড্রোনও। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে আটক হয়েছেন মিয়ানমারের ছয়জন নাগরিক। শনিবার দেশটির সামরিক বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে সীমান্তে অবস্থানের চিত্র দেখা গেছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ছিল গ্রেনেড লঞ্চার, মর্টার ও মেশিনগান।

উপরোক্ত বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আসার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে আরো কৌতুহলের জন্ম দিচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন মিয়ানমার বাংলাদেশকে যুদ্ধের উস্কানি দিচ্ছে কিনা কিংবা মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বারবার বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করলেও বাংলাদেশ শুধুমাত্র প্রতিবাদ জানিয়েই চুপ থাকছে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, মিয়ানমার যুদ্ধে জড়াতে চাইছে না তবে বাংলাদেশকে ঠিকই উস্কানি দিচ্ছে। যে কূটনীতিক চাল চেলে মিয়ানমার বাংলাদেশকে উস্কানি দিচ্ছে, বাংলাদেশ সেই উস্কানিতে পা না দিয়ে তার চেয়ে বেশি বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছে। মিয়ানমার যে সমস্যার তৈরি করছে তাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে কোনো রকম হুমকি তৈরি না হলেও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সংকট তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, এসব কাজের পুনরাবৃত্তি করে মিয়ানমার বাংলাদেশকে উস্কানি দিচ্ছে যেন বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আর এ রকমটা হলে তখন বিশ্ব মিডিয়ার চোখ রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে সরে যাবে এবং সবাই সীমান্তের বিষয়টি নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের এই ফাঁদে পা দেয় তখন সবাই সংঘর্ষ নিয়ে কথা বলবেন। সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য জাতিসংঘ দুই দেশকেই চাপ দিবে। তখন ঢাকা পড়ে যাবে রোহিঙ্গা সমস্যা।

তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার আমাদের কোনো মানুষের ওপর এখনও হামলা চালায়নি। যদি এমনটা হয়ে থাকে তবে সেটা সামরিকভাবে জবাব দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে মিয়ানমারের ফাঁদে পা না দিয়ে বাংলাদেশের উচিত হবে কূটনীতিক বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সমাধান করা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী সিকদারও কথা বললেন একই সুরে। তিনি বলেন, মিয়ানমার যে সংকটটা তৈরি করেছে সেটা সম্পূর্ণ মানবিক সংকট এবং সারা বিশ্ব এর নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে রাশিয়া অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে আখ্যা দিলেও রোহিঙ্গারা যেহেতু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সুতরাং সেটি আর মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নেই। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে পুরো বিশ্বই বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।

মিয়ানমার নিয়ম লঙ্ঘন করে এখন পর্যন্ত যে কাজগুলো করেছে তাতে কোনোভাবেই যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমারের হেলিকপ্টার যেভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাতে আক্রমণাত্মক ভাব ছিল না। তারা শুধুমাত্র বাংলাদেশকে উত্তেজিত করতে চাইছে। এই মুহূর্তে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো সামরিক ঝামেলায় না জড়িয়ে কূটনৈতিকভাবে বিষয়টির মোকাবেলা করতে হবে।

যুদ্ধ কোনো দিনই সমস্যার সমাধান করে না বলে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ যদি এখন মিয়ানমারের উস্কানিতে সাড়া দিয়ে সীমান্তে সংঘর্ষে জড়ায় তবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সকলের সামনে থেকে সরে যাবে এবং বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার সুযোগ পাবে মিয়ানমার। আর এই রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করলে সমস্যাটা শুধু সাধারণ থাকবে না বরং এদের অনেকেই জড়িত হতে পারে জঙ্গিমূলক কর্মকাণ্ডে। যেটা পরবর্তীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে কূটনৈতিকভাবে বিষয়টির মোকাবেলা করা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশীদ বলেন, নিয়ম লঙ্ঘন করে মিয়ানমার যেসব সামরিক উত্তেজনার সৃষ্টি করছে তা কোনোভাবেই যুদ্ধ পর্যায়ে যায়নি। এছাড়া লঙ্ঘিত হয়নি বাংলাদেশের নিরাপত্তাও। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে সামরিক বল প্রয়োগের বিপরীতে কূটনৈতিকভাবে বিষয়টির মোকাবেলা করার। শান্তিপূর্ণভাবে বিষয়টির সমাধান করে মিয়ানমার ছেড়ে আসা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি তৈরির আগেই তাদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়া।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতেই মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশে প্রবেশ করছে এবং তাদের ওপর নিয়মিত নির্যাতনের অংশ হিসেবেই সীমান্তে মাইন পুঁতে তাদের গতিরোধের চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। বাংলাদেশকে কিছুটা উত্তেজিত করার চেষ্টা করলেও সেই ফাঁদে বাংলাদেশ পা দিবে না এবং মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মত বিশেষজ্ঞদের। -সময় নিউজ