ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষে ভাগ্য বদল মিরাজের

গোপাল চন্দ্র দে,ভোলা প্রতিনিধি: ভোলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের যুবক আবদুর রহমান মিরাজ নদীতে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে স্থানীয়। অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেছিলো সে কিন্তু চাকরির জন্য বসে না থেকে নিজ উদ্যোগে মাছ চাষ শুরু করে। বর্তমানে মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় তার।

কোনো মাসে এর চেয়ে বেশি লাভ হয়। প্রথম দিকে পুকুর ও ঘেরে মাছ চাষ করলেও তিন বছর হলো নদীতে নেটের (জাল) এর সাহায্যে তৈরি করা খাঁচায় বিভিন্ন ধরনের মাছ পালন করছেন। উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০টি খাঁচা ও ৭ হাজার মাছের পোনা সরকারিভাবে প্রদান করা হয়েছে মিরাজকে।

আর এতেই সফলতা ধরা দেয় মিরাজের জীবনে। কঠোর পরিশ্রম ও মৎস্য অধিদপ্তরের পরামর্শে আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন শিক্ষিত এ যুবক। তাকে দেখে এখন অনেকেই খাঁচায় মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বেকারত্ব দূর করতে যুবকরা গড়ে তুলছেন নদীর পাড়ে নেট দিয়ে ছোট ছোট মাছের প্রকল্প। খুব অল্প সময়ে প্রাকৃতিক উপায়ে বিক্রির উপযোগী হয় এসব মাছ। এর স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় বাজারে চাহিদাও প্রচুর।

সরেজমিন ভোদুরিয়ার ৩নং ওয়ার্ডের শেরেবাংলা বাজারসংলগ্ন তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে মিরাজের মাছের খামারে গিয়ে দেখা যায়, ১৫টি খাঁচায় তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, মিরর কার্প (লাল মাছ) মাছ চাষ করছেন। খাঁচার চারপাশে লোহার পাইপ, বাঁশ ও ড্রাম দিয়ে শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ১০ ফুট বাই ২০ ফুটের খাঁচাগুলোর গভীরতা ৮ ফুট। প্রতিটি খাঁচায় ২ হাজার করে মোট ৩০ হাজার মাছ রয়েছে। সার্বক্ষণিক থাকা ও মাছের খাবার, নেট রাখার জন্য নদী পাড়ে একটি ঘর তৈরি করেছেন। মিরাজকে দেখা যায়, নৌকায় করে মাছের খাবার দিচ্ছেন।

মিরাজ বলেন, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে বেড়ে ওঠা এসব মাছের রোগ-বালাই হয় না। তাই কোনো ওষুধের প্রয়োগ নেই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিক্রি করা যায়। পুকুর বা ঘেরে একটি তেলাপিয়া মাছ এক কেজি হতে সময় নেয় ছয় থেকে সাত মাস, আর নদীতে খাঁচায় তেলাপিয়া কেজি হয় তিন থেকে চার মাসে। প্রতি তিন মাস পর পর মাছ বিক্রি করা হয়।

মিরাজ জানান, জীবনের প্রথমদিকের গল্প। ২০০৭ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করার পর চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চাকরির জন্য বসে না থেকে পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করেন। পরে পত্রিকায় খাঁচায় মাছ চাষের খবর দেখে আগ্রহী হন। মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আলাপ করলে তারা উৎসাহ দেন। তাদের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন ও পরামর্শে শুরু করেন মাছ চাষ। এছাড়া সরকারিভাবে ১০টি খাঁচা ও ৭ হাজার মাছ পাওয়াতে প্রথমদিকে তার খরচও অনেক কম হয়েছে বলে জানান।

বর্তমানে আরও পাঁচটি খাঁচা নিজ উদ্যোগে নদীতে স্থাপন করেছেন তিনি। মিরাজের নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের সাফল্য দেখে অনেকেই খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেছেন। স্থানীয় জহিরুল ইসলাম সজিব, এনামুল হক শাহজাদ, আজাদ রহমান ও রফিকুল ইসলাম মিরাজকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে খাঁচায় মাছ চাষ করছেন। রোগ-বালাই না হওয়াতে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। তারাও বর্তমানে মাছ বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি এলাকার অনেক বেকার যুবক খাঁচায় মাছ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

স্থানীয় খাঁচায় মাছ চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, এ এলাকায় নদীতে খাঁচায় মাছ চাষের ধারণা তারা মিরাজের কাছ থেকেই পান। পুকুরে মাছ চাষে বিভিন্ন রোগ-বালাই হলেও এ পদ্ধতিতে কোনো অসুখ নেই। পানি বদলানোর কোনো ঝামেলা নেই। পুকুরের মাছের চেয়ে এর দাম বেশি হওয়ায় অনেকেই নেট দিয়ে মাছ চাষ করতে চাচ্ছেন। মিরাজের সাফল্য উৎসাহিত করছে গ্রামের অনেক শিক্ষিত যুবককে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মাকসুদ আলম বলেন, একজন অনার্স পাস ছেলে হয়েও মিরাজ যেভাবে পরিশ্রম করে নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করছেন, তা সবার জন্য অনুকরণীয়। তিনি সারা রাত জেগে মাছের প্রকল্প পাহারা দেন। কাজের প্রতি ভালোবাসা আছে বলে আজ সফলতা ধরা দিয়েছে। মিরাজ হয়েছেন একজন সফল মৎস্য চাষি। এ ব্যাপারে সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, মিরাজ একজন শিক্ষিত মানুষ। তাকে প্রথম বলার পর সে নদীতে খাঁচায় মাছ চাষে রাজি হয়।

সরকারিভাবে তাকে ১০টি খাঁচা ও মাছ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাকে একটি মাছ চাষের গ্রুপের প্রধান করে এ কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি বলেন, তাকে দেখে এখন অনেক খাঁচায় মাছ চাষ শুরু করেছেন। মিরাজ খাঁচায় মাছ চাষের সঙ্গে তার পারিবারিক উন্নতি ও আত্মকর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করেছেন। মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মিরাজসহ সব চাষিকে সব ধরনের পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান আসাদুজ্জামান।

আবদুর রহমান মিরাজ আরও জানান, ভিয়েতনামের মাছ সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু আমাদের খাঁচায় মাছের গুণগতমান ঠিক থাকলেও আমরা তা পারছি না। ফলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বি ত হচ্ছে দেশ। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ সহযোগিতা চেয়েছেন মিরাজ।