এম.এম রুহুল আমিন, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিঃ কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তারদের চেম্বার কিংবা ক্লিনিকের সামনে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিগণ। তারা রোগি কিংবা তাদের সাথে আসা স্বজনদের কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন (ব্যবস্থাপত্র) নিয়ে কৌশলে মোবাইলে ছবি তুলে নিজেদের অবস্থান কোম্পানীর কাছে তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
একটি সূত্র জানায়, ওষুধ কোম্পানির প্রনিতিধিদের চাকরির পূর্বশর্ত হিসাবে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকার ওষুধ বিক্রি করতে বাধ্যতামূলক টার্গেট রয়েছে কোম্পানিগুলোর। এ কারণে বিক্রয় প্রতিনিধিরা চাকরি বাঁচাতে টার্গেট পূরণ করতে নানা ছলচাতুরি ও প্রলোভন দেখিয়ে প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় সব রকমের ওষুধ ডাক্তারদের ম্যানেজ করে লিখিয়ে থাকে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা ডাক্তারদের কলম, প্যাড, চাবির রিং থেকে শুরু করে টিভি-ফ্রিজ ও অন্যান্য আসবাবপত্রও সরবরাহ করে থাকে বলে জানা যায়।
তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বর্হি-বিভাগ থেকে রোগী বেড়িয়ে আসলে প্রতিনিধিদেরকে ব্যবস্থাপত্র দেখাতে হচ্ছে। এতে রোগী ও তার সাথে আসা স্বজনেরা অতিষ্ট হয়ে উঠে। রোগীদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাদের কোম্পানির ওষুধ লেখা আছে কিনা তা দেখতে রোগীদের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন তারা। তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. বদরুল হাসান ও ডা. ফিরোজ মিয়ার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা অনেক রোগীদের অভিভাবকগণ বলেন, অনেক সময় অপেক্ষার পর ভেতরে গিয়ে আমাদের রোগীদের ডাক্তার দেখালাম।
বেড়িয়ে আসতেই ওষুধ কোম্পানির আট-দশজনেরও বেশি লোক প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে আমরা বিব্রতবোধ করছি। অন্য আরেক ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দেখা যায়, আরো একজন রোগীর সাথে কথা বলছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। অন্য একজন প্রেসক্রিপশন নিয়ে কৌশলে মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। রোগীর কাছে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলে রোগীর সাথে থাকা তার বারো-তেরো বছরের ছেলে রাগান্বিত হয়ে বলে ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে কি লিখেছে আপনাকেও দেখাতে হবে নাকি?
পরে সাংবাদিক পরিচয় দিলে সে জানায় উপজেলার রাউতি ইউনিয়নের মেছগাঁও গ্রাম থেকে মাকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তার দেখানোর জন্য। ডাক্তার দেখিয়ে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসার সাথে-সাথে চার-পাঁচজন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাদের কোম্পানির ওষুধ লেখা আছে কিনা তা দেখতে চায়। অন্য আরেকজন ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আমি আপত্তি জানালেও কোনো কাজ হয়নি। উপজেলার সরকারি হাসপাতালের এই চিত্র চলছে প্রতিদিন। ক্লিনিক ও ডাক্তারদের চেম্বার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সেল্স প্রতিনিধিদের মহড়া।
তারা দল বেধে প্রতিটি ডাক্তারের চেম্বারের আশেপাশে ঘুরঘুর করে এবং ডাক্তারদের সাথে দেখা করে কোম্পানির ওষুধ স্যাম্পল দিয়ে থাকে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে মার্কেটিং প্রমোশনের নামে প্রতিদিন চলছে অসুস্থ্য বাণিজ্যের প্রতিযোগীতা। ছোট-বড় প্রায় সব কোম্পানি নিজ প্রতিষ্ঠানের ওষুধ বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে মার্কেটিং প্রমোশনের নামে ডাক্তারদের পিছনে স্থানীয় প্রতিনিধি লাগিয়ে রেখেছেন। ব্যবস্থাপত্র দেখানোকে কেন্দ্র করে অনেক সময় রোগীর স্বজনদের সাথে ওষুধ প্রতিনিধিদের বাকবিতন্ডার ঘটনাও ঘটে অহরহ।
নাম না প্রকাশের শর্তে কয়েকটি ফার্মেসীর ব্যবসায়ীরা জানান, ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী মার্কেটিং নীতির ফলে দেশে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবহার বেড়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি ওষুধ বাজারজাত করণ নীতিমালা থাকলেও তা কেউই মানছেন না। ফলে অর্থলোভী ডাক্তার, হাতুড়ে ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টদের ফাঁদে পড়ে অশিক্ষিত এবং দরিদ্র রোগীরা ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সেবন করে প্রতারিত হচ্ছেন।
তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মৌল্লা মো. মতিউর রহমানের সাথে হাসপাতালে প্রতিনিধিদের অহরহ পদচারণা নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবাধ বিচরণের বিষয়টি নিয়ে অচিরেই আমরা আলোচনায় বসব।