চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে চেম্বার, দন্ত-চিকিৎসক ঢাকায়, রোগীর চিকিৎসায় বিচিত্র কম্পাউন্ডার

জে.জাহেদ,চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর কর্ণফুলীতে দন্ত চিকিৎসার নামে গলা কাটা বানিজ্যের অভিযোগ ডাক্তারের এক এসিস্ট্যান্ট কিংবা কম্পাউন্ডার এর বিরুদ্ধে। নাম তার আবু সালেহ মোঃ নাসিম। পড়ালেখা কতটুকু করেছেন তা সঠিক জানাতে পারেননি। দন্ত ক্লিনিক খুলে বসেন উপজেলার চরপাথরঘাটার আনোয়ার সিটির নিচতলায়। চেম্বারের নাম সূচনা ডেন্টাল কেয়ার। সামনের সাইন বোর্ডে বিডিএস ডিগ্রীধারী ডাক্তারের নাম ডাঃ মোঃ খোরশেদুল ইসলাম। বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে যার বিএমডিসি নং ৬১৭০। যা সত্য বলে তথ্য পাওয়া যায় ওয়েব সাইটে।

তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। এই ডাক্তার ঢাকা হতে কর্ণফুলীতে সপ্তাহ আসেন মাত্র দুদিন। বাকি ৫দিন ডাক্তারের সাথে থাকা কম্পাউডার আবু সালেহ মোঃ নাসিম বনে যায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। ডাক্তারের অবর্তমানে সপ্তাহের বাকি ৫দিন তিনিই দন্ত চিকিৎসক এ চেম্বারে। চিকিৎসা দেন সাথে ঔষুধও লিখেন প্রেসক্রিপশনে। তবে আজব বিষয় হলো প্রেসক্রিপশন ও গলাকাঁটা। প্রেসক্রিপশন এর উপরি অংশ কাটা। নিচের অংশে হাতের কাজ সেরে লিখে দেন হাই এন্টিবায়োটিক ট্যাবলেট ও ১০ টাকা দামের ব্যথার ঔষুধ। যে লিব্যাক ৫০০মিঃ গ্রাঃ ক্যাপসুল ও রোলাক ১০০মিঃ গ্রাঃ ট্যাবলেট একমাত্র সরকারি রেজিষ্ট্রেট চিকিৎসক লিখতে পারেন।

এ যেন রমরমা বানিজ্য। অভিযোগে জানা যায়, দাঁতের রোড ক্যানেল ৬হাজার ও ক্যাপ বসানো ২হাজার। সব মিলে আনোয়ারা বেগম হতে ৮ হাজার। ৫বছরের দাঁতের কোন সমস্যা হবেনা মর্মে গ্যারান্টি দিয়ে আদায় করে নেন ৬হাজার। কিন্তু বিপত্তি বাধে মাত্র ১২দিনের মাথায় দাঁতের অংশ ঝরে যাওয়ায়। ফলে রোগি আনোয়ারা বেগমের স্বামী কামালের সাথে কম্পাউন্ডার নাসিমের টাকা ফেরত নিয়ে হাতাহাতির মত ঘটনাও ঘটে।

এদিকে, রহিমা বেগম নামে আরেক রোগি হতে ৪ হাজার, সিএনজি ড্রাইভার রফিক হতে ৫হাজার দাঁতের সমস্যায় নিয়েছে বলে অভিযোগ। প্রেসক্রিপশনের কাগজে দাঁতের ব্রিজ ক্যাপ ও রুট ক্যানেল সহ কসমেটিকস, ফিলিং ও অত্যাধুনিক যন্ত্র ধারা দন্ত রোগের চিকিৎসা করা হয় লিখা থাকলেও ক্লিনিকে নেই কোন মূল্য তালিকা। যার কাছ হতে যত টাকা নেওয়া যায়। পরে দাঁতের কোন এক্সওে দরকার হলে শহরে পাঠায়। কাজটি করে মুলত ডাক্তারের সহকারী নামধারী মোঃ নাসিম এমনটি অভিযোগ অনেকের।

উপজেলায় এর রকম অহরহ অভিযোগ রয়েছে, ডিগ্রি নেই কিন্তু তারপরও অনেকই নিজেকে ডাক্তার, ডেন্টিস্ট, ডেন্টাল সার্জন, কনসালটেন্ট পরিচয় দিয়ে কিংবা ভুয়া সনদ নিয়ে ক্লিনিক খুলে চিকিৎসার নামে ব্যবসা করছেন। যাদের বেশির ভাগেই কম্পাউডার।
কেননা আসল ডাক্তার আসে সপ্তাহে দুদিন বাকি ৫দিন সহকারিরা বিজ্ঞ দন্ত চিকিৎসক সেঁজে সেবা দিচ্ছে। যারা এভাবে ক্ষতি করছে সাধারন মানুষের দাঁত ও শরীরের।

বিশেষজ্ঞ দন্ত চিকিৎসকেরা বলছেন, এসব আজগবি ডাক্তার নামধারী অপ-চিকিৎসার কারণে অনেকেই হারাচ্ছেন জীবনের মূল্যবান সম্পদ দাঁত ও এনামেল। এর পরেও এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া-সহ জনসচেতনতা বৃদ্ধি তেমন চোখে পড়েনা। কয়েকমাস আগেও এই দন্ত চিকিৎসক দাবিদার নাসিম ছিলো বেকার যুবক। পরে নিজেকে দাঁতের ডাক্তার হিসেবে উপজেলার বহু জায়গায় চেম্বার খুলে বসলেও বেশি দিন এক জায়গায় বসেনি বলে এলাকার আরেক ব্যবসায়ী নাছিরের অভিযোগ।

বর্তমানে আনোয়ার সিটি মার্কেটের নিচ তলায় যার অবস্থান। মাত্র ৪মাস আগে সূচনা ডেন্টাল ক্লিনিকটি খুলে বসে। পুরাতন একটি মেশিন নিয়ে। ক্লিনিকটির ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে এক রোগীর দাঁতের চিকিৎসা করছেন এই চিকিৎসক। বাইরে অপেক্ষা করছেন আরও দুজন। তারা জানেন না, নাসিম প্রকৃত ডাক্তার নাকি ভুয়া। ২০ মিনিট অপেক্ষার পর এর সঙ্গে কথা হয়। কি কি চিকিৎসা সেবা দেন জানতে চাইলে বলেন, ডেন্টাল ক্রাউন , ওরাল সার্জারি, স্থায়ী ও অস্থায়ী ফিলিং, লাইট কিউর মেশিনে ফিলিং, পলিসিং, আকাঁ-বাঁকা দাঁত সোজা করা, দাঁত উঠানো, দাঁত বাধানো, রুট ক্যানেল, ক্যাপ বসানো, সিস্ট অপারেশনসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করেন বলে জানান।

ভিজিটিং কার্ডও প্যাডে লেখা অনুযায়ী ডেন্টাল ডাক্তার বা সার্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে কম্পাউন্ডার আবু সালেহ মোঃ নাসিম বলেন, আসল ডাক্তার ঢাকায় থাকে, সপ্তাহে দুদিন আসে। সাইনবোর্ডে লেখা শুক্রবার সহ ৭ দিন খোলা দেখে বাকি ৫দিন কে চিকিৎসা দেয় জানতে চাইলে তিনি জানায় সে নিজেই চিকিৎসা দেয়। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব! ডাক্তার যদি ঢাকায় থাকে তাহলে চেম্বার তো কর্ণফুলীতে। কি করে আপনি এই সেবা দেন জানতে চাইলে প্রতিনিধিকে জানান, তিনি মুঠোফোনে রোগীর সমস্যার কথা ঢাকায় থাকা ডাক্তারকে জানায়, পরে ডাক্তার যেভাবে চিকিৎসা দিতে বলেন সেভাবে চিকিৎসা দেন তিনি।

সরকারী নিয়মে কারা কারা নিজের নামের আগে ডাক্তার পদবী ব্যবহার করতে পারেন ? এমন প্রজ্ঞাপনে জানা যায়,বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অ্যাক্ট ২০১০(২০, ডিসেম্বর ২০১০-এ প্রকাশিত গেজেট) এর ধারা ২২(১) ও ২৯ (১) এর আওতায় গইইঝ/ইউঝ বাদে অন্য চিকিৎসকদের নামের আগে ডা. (ডাক্তার) পদবী ও নামের পরে ডিগ্রী ব্যবহার অপরাধ। ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কেউ তাদের নামের পূর্বে ডাক্তার পদবী লিখতে পারবেন না। তাও আবার তাকে বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটানো শাস্তি যোগ্য অপরাধ।

এমন ব্যাখ্যায় বোঝার আর বাকি থাকে না যে মোঃ নাসিম একজন প্রকৃত ডাক্তার নাকি ডাক্তার সেজে প্রতারণা করছেন। এভাবে রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছে প্রতিটি বাজারে কোন না কোন দন্ত চিকিৎসক নামে ভূয়া ডাক্তার। এদিকে বিএমডিসির আইনের ২২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধন ব্যতীত এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা দেওয়া নিষিদ্ধ। অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেনো এ আইনের অধীনে নিবন্ধন ব্যতীত কেউ নিজেকে মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক বলে পরিচয় প্রদান করতে পারবে না।

কোনো ব্যক্তি এ ধারা লংঘন করলে ৩ বছরের কারাদন্ড- অথবা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড- অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। এ বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে চেম্বারের প্রকৃত ডাক্তার মোঃ খোরশেদুল ইসলাম জানায়, সে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতাল হতে বিডিএস পাশ করেছে। কিন্তু চেম্বারের বাহিরে ঢাকা থাকলেও মুঠোফোনে তার কম্পাউডারকে চিকিৎসার নির্দেশ দেন বলে স্বীকার ও করেন তিনি। এভাবে যদি এতো সহজে মুঠোফোনে জটিল দাঁতের চিকিৎসা দেওয়া যায় তবে দেশের সব কম্পাউডার ডাক্তার সেঁজে চিকিৎসা দিতে কার্পণ্য করার কথা নয় বলে মন্তব্য করেন চরপাথরঘাটা এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান এম মঈন উদ্দীন।