মাদকের অভয়ারণ্য ভারত সীমান্ত

এবিএস রনি, শার্শা (যশোর) প্রতিনিধি: কঠোর নজরদারির পরও ফাঁকফোকর দিয়ে আসছে মাদক ‘প্রায়ই শুনি মাদক ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে, আটক হচ্ছে মাদক, বিচারে সাজাও হচ্ছে, খাটছে জেল, মাদকসেবীরা ওয়াদা করছে আর মাদক সেবন করবো না, গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাদকের আস্তানা, পাচাররোধে বিজিবি-বিএসএফএর মধ্যে বৈঠক হচ্ছে ঘনঘন, হরহামেশা উদ্ধারও হচ্ছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশের অভিযানে-তারপরেও কেন ভারত থেকে ফেনসিডিলসহ মাদক আসা বন্ধ হচ্ছে না।

এসব প্রশ্ন সীমান্তে মাদক পাচার ও আটক হওয়া ঘটনা প্রত্যক্ষকারী অনেক বাসিন্দার। আসলেই এটি সত্য এতোকিছুর পরও জীবন বিনাশী ফেনসিডিলের ভয়াল থাবা কোনভাবেই রুখে দেয়া যাচ্ছে না। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের বেনাপোল, সাদীপুর, পুটখালী, গোগা, ভূলোট, শিকড়ী, দৌলতপুর, রুদ্রপুর, চান্দুরিয়া, চৌগাছা, দর্শনা, কলারোয়াসহ বিভিন্নস্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত থেকে ফেনসিডিল আসছেই। একেবারে বন্ধ হয়নি কখনো, তবে মাঝে কিছুদিন ফেনসিডিলের ব্যবহার অনেকটাই কমে গিয়েছিল।

দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে সর্বনাশা ফেনসিডিল ঢুকছেই। তবে সীমান্তপথে ভারতীয় অন্যান্য পণ্যের চোরাচালান এখন নেই বললেই চলে। বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রায়ই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার পর বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল আটক করে। তবুও বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফেনসিডিল ঢুকছে তা সীমান্তে উদ্ধারের ঘটনায় প্রমাণ করে। প্রায়ই সীমান্ত থেকে ভারত থেকে আসা ফেনসিডিল আটকের পরও বন্ধ না হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক কর্মকর্তাও প্রশ্ন ছুঁড়েন ফেনসিডিলের চালানের কি শেষ হবে না?

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক সূত্র জানায়, আপ্রাণ চেষ্টা চলছে, তবুও ভারতীয় ফেনসিডিলসহ মাদক বাংলাদেশে ঢুকছেই সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে। ছোট বড় চালান আটকের ঘটনা ঘটছে অহরহ। চলতি মাসের কয়েকদিনে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় ফেনসিডিল উদ্ধার হয়েছে বেনাপোল ও আশেপাশের সীমান্তে। গত ৬অক্টোবর যশোর ৪৯ বিজিবি আড়শিংড়ী সীমান্ত থেকে ১শ’৪৮ বোতল, ৭অক্টোবর খুলনা ২১ বিজিবি বেনাপোলের পুটখালী থেকে ৯৪ বোতল, ৮অক্টোবর দৌলতপুর খানপাড়া মাঠ থেকে ৫শ’ বোতল, ৯অক্টোবর খালপাড় থেকে ১শ’বোতল, ১৫অক্টোবর পুটখালী থেকে ৩শ’৯০ বোতল, একই পয়েন্ট থেকে ১৬অক্টোবর মহিলা চোরাচালানীকে আটক ও ৩০ বোতল, ১৭অক্টোবর বেনাপোল পৌর এলাকার বড়আঁচড়া সীমান্ত থেকে ৪৯ ব্যাটালিয়নের বিজিবি সদস্যরা ১ হাজার ৫০ বোতল ফেনসিডিলসহ ওই পাচারকারীকে আটক করেন।

রাতদিন টহল দিয়ে পরিশ্রম করে বিজিবি সদস্যরা সীমান্ত থেকে কখনো মালিকবিহীন, কখনো ফেনসিডিলসহ চোরাচালানী আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। তারপরেও থামছে না ফেনসিডিল চোরাচালান। শুধু তাই নয়, শার্শার বাগআঁচড়ায় ১৬ সেক্টেম্বর আজিজুল ও ফারুক নামে তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী আপন দুই ভাই একই দিনে নিহত হয়। তার কিছুদিন আগে নিহত হয় শার্শার মাদক সম্রাট দুখী,
যশোররে ১৬ অক্টোবর ভোরেও জাহিদ নামে এক তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। অপরদিকে ১৫ অক্টোবর রাতে বেনাপোলে সাদীপুরে মাদক ব্যবসায়ীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে এক সিএ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীকে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, উস বন্ধ না করে যতরকম ব্যবস্থাই নেওয়া হোক শূন্যের কোঠায় আসবে না ফেনসিডিলসহ মাদক ব্যবসা। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বেনাপোল, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঢাকার বেশ কয়েকজন গডফাদার কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে ‘সর্বনাশা ব্যবসা’ পরিচালনা করছে। ওয়ার্ল্ড ড্রাগ রিপোর্ট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও মাদক নিয়ন্ত্রণে দেশে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও সূত্রে জানা গেছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এই মাদকসেবীদের একটা বড় অংশের কাছে পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা।

সীমান্ত সূত্র জানায়, বেনাপোলের ওপারের কৃঞ্চপদ, গোপাল ও আশিক এবং এপারের বিপুল, জাকির ও আলমগীরসহ সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী একটি চক্র আছে, যাদের নেটওয়ার্ক ঢাকা ও কলিকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। তাদের রয়েছে অসংখ্য সদস্য। এর বাইরেও গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দর্শনা, চৌগাছা, মহেশপুর, শার্শা, গাংনী, কলারোয়া, ভোমরা, বাগআঁচড়া, দৌলতপুর, ভেড়ামারা ও প্রাগপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে শত শত চোরাচালানী। বিভিন্ন সময়ে মাদক ব্যবসার চুনোপুটিরা আটক কিংবা ক্রসফায়ারে নিহত হলেও গডফাদাররা সবসময় থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ, মাদক চোরাচালান গ্রুপগুলোর নেপথ্যে শক্তি যুগিয়ে থাকেন একশ্রেণির জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি।