মামুন হত্যাকারীদের এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ

জে.জাহেদ, চট্টগ্রাম ব্যুরো: কর্ণফুলীতে ছাত্রলীগ নেতা মামুন আল রশীদ হত্যার ২৪ দিন অতিবাহিত হলেও মামলার প্রধান আসামিরা এখনও গ্রেফতার হয়নি। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছেন নিহতের পরিবারের সদস্যসহ এলাকাবাসী। এছাড়াও চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বরে হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবীতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে নিহতের পরিবারসহ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ ও এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। এতে নিহত মামুনের বড় ভাই মামলার বাদি মো. ইয়াছিন অভিযোগ করেন, থানা পুলিশের ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ আমার ভাইয়ের হত্যাকান্ডের ২৪ দিন পেরিয়ে গেলেও মূল হত্যাকারীদের এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এতে নিহতের পরিবার উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছে বলে জানান।

সবাই মনে করছিলো দুই একদিনের মধ্যে খুনিরা গ্রেফতার হবে কিন্তু এতোদিনেও খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় স্থানীয় জনসাধারণ পুলিশ বাহিনীর প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এ সময় বাদি দ্রুত খুনিদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী ও মামলাটা পিবিআই’র কাছে হস্তান্তরেরও আবেদন জানান। তবে ইতিমধ্যে কিশোরগঞ্জ থেকে এজাহারভুক্ত আসামি ওমরকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে পাঠালেও তার জবানবন্দি মতে খুনের ঘটনায় আরো দুজন ইন্ধনদাতা বা হুকুমদাতার নাম এসেছে বলে শোনা যাচ্ছে। যারা মামুন হত্যা মামলায় পুলিশের তদন্তে ফেঁসে যেতে পারেন। হতে পারে তাদের অনেকেই বড় ভাই কিংবা ছোট ভাই। এরা উপজেলার কথিত বড়ভাইদের পিছনে রাজনীতি করে বলে সুত্র জানায়।

যদিও হত্যাকা-ে অংশ নেওয়া মূল আসামি ও ইন্ধনদাতারা অধিকাংশে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং খুনের মোটিভ বা মূল রহস্য এখনো জানা যায়নি। বলতে গেলে একজন ছাড়া হত্যাকা-ে অংশ নেওয়া মূল অপরাধীদের এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২৪ দিন পার হলেও মূল খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাহিরে এবং খুনের উদ্দেশ্যে বা রহস্য অধরায় রয়েছে বলে স্থানীয়দের ক্ষোভ রয়েছে।

জানা যায়, ছাত্র রাজনীতির দলাদলি ও আধিপত্য বিস্তার কিংবা মাদকবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকার কারণে ঘাতকেরা মামুনকে খুন করে থাকতে পারে বলে তথ্য এসেছে। তবে পুলিশ কোন রহস্য বের করতে না পারলেও স্থানীয় অনেকে জানান, মূলত মামুন এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গেলেই নিমর্ম ভাবে খুন হন।

কি আছে আসামী ওমরের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেঃ

জাবনবন্দিতে ওমর জানায়, এ বছর পশ্চিম পটিয়া এজে চৌধুরী কলেজ থেকে আমি এইচএসসি পাস করেছি। এলাকার বড় ভাই মামুন ও আজিজের (আহত) সঙ্গে আমরা এলাকায় একত্রে রাজনীতি করি। যুব উন্নয়নে কম্পিউটার শেখার জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর বন্ধু আজগরের (আসামি) সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের নিউ মার্কেট এলাকায় দোস্ত বিল্ডিংয়ে যাই। ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এলাকার বন্ধু আজম তাকে ফোন করে জানায়, আশিক ও শাহেনুরকে মারধর করেছে মামুন (নিহত)। ‘মার খাওয়া’ বন্ধুরা মোবাইল ফোনে তাকে ও তার বন্ধুদের শাহমীরপুরে যাওয়ার জন্য বলে।

এর কিছুক্ষণ পর সুমন তাকে ফোন করে। শাহনুরের চাচাতো ভাই পারভেজের বন্ধু সুমন। তার বাড়িও একই এলাকায়। সুমন তাকে চকবাজারে আসার জন্য বলে। সুমন জানায়, শাহেনুর তাকে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছে। ফোন পাওয়ার পর দুপুর দেড়টার দিকে তারা শহরের চকবাজার গুলজার টাওয়ার মোড়ে যায়। সেখানে সে, সুমন ও আজগর চায়ের দোকানে বসে আলোচনা করে। একপর্যায়ে সুমন বলে, পারভেজ তাকে বলেছে মামুন যেহেতু শাহেনুর ও আশিককে মেরেছে তাই মামুনকে মারতে হবে।

এ বিষয়ে সেখানে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে তাদের মধ্যে কথা হয়। জবানবন্দিতে ওমর জানায়, তারা কর্ণফুলী উপজেলার শাহমীরপুর তালতলায় অবস্থাান নেয়। এরপর তাদের সঙ্গে আশিক, আজম ও শাহনুর যোগ দেয়। সুমন আলাদাভাবে বাদামতলায় যায়। সুমনের ফোন পেয়ে সে, শাহেনুর, আশিক, আজগর ও আজম পরিকল্পনা করে মামুনকে মারার।

আজম একটি রাম দা, শাহেনুর তার মামার বাড়ি থেকে দুটি কিরিচ ও আজগর তার বাসা থেকে একটি চাইনিজ কুড়াল আনে। ঘটনার দিন আসরের আজানের সময় সুমন তাকে ফোন দেয়। শাহেনুরের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে সুমন জানায়, মামুন তার ঘরের সামনে গরুর খড় শুকানোর কাজ করছে। সেখানে তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য তাকে বলে।

ওমর জানায়, এর মধ্যে সে আবার জানতে পারে মামুনকে মারার জন্য আজগরকে সুমন ৫০ হাজার টাকা দেবে। মাগরিবের সময় ওমর, আশিক, শাহেনুর, আজগর, আজম ঘটনাস্থালে যায়। ওমর জানায়, ঘটনাস্থালে যাওয়ার পর তারা দেখে মামুন ও আজিজ রাস্তার মোড়ে বসে গল্প করছে। এ সময় তারা রামদা, কিরিচ ও চাইনিজ কুড়াল নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। কিরিচ দিয়ে সে ও আজগর চাইনিজ কুড়াল দিয়ে প্রথমে মামুনকে কোপ মারে।

এরপর আজিজের ডান পায়ে সে কোপ মারে। শাহেনুর মামুনকে এলোপাতাড়ি কোপ মারে। আশিকও মামুনকে কোপ মারে। মামুন ও আজিজকে মারার পর তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় নালার মধ্যে তাদের কিরিচ, চাইনিজ কুড়াল ফেলে দেয়।
স্বীকারোক্তিতে ওমর জানায়, হামলা করার পর তারা প্রথমে শিকলবাহা ক্রসিংয়ে আসে। পরে হেঁটে কালারপুল পৌঁছে। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে খবর পায় মামুন মারা গেছে।

এরপর শহরে মোবাইল ফোন বিক্রি করে তারা অলংকার মোড়ে যায়। সেখান থেকে তারা ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় এক দিন থাকার পর সে কিশোরগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যায়। সেখান থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত আজিজ জানান, ঘটনার দিন দুপুরে ডাঙ্গামার্কেট বাজারে সেলুনে বসা আশিককে একটা থাপ্পড় মেরেছিল মামুন। এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। বিষয়টি মামুন সেদিন তাকে জানায়।

ঘটনাস্থলে থাকা প্রধান স্বাক্ষী আহত আজিজের ভাষ্যে জানা যায়:

সন্ধ্যায় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার ২৫/৩০ মিনিট আগে মামুন উপজেলার শাহমীরপুর ডাঙ্গা মার্কেট হতে মোবাইলে ৪৯ টাকা ইজিলোড করে হেঁটে হেঁটে তার বাসার দিকে যান। আজিজ তখন বাজারে ছিলো। তার কিছুক্ষণ পর আজিজের ফোনে মামুনের একটি মিস কল আসে।
কল ব্যাক করলে আজিজকে মামুন জানায় যে তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এবং সেখানে আজিজকে যেতে বলেন। পরে আজিজ গেলে তারা দুজনে রাস্তার পাশে একটি নাম ফলকের উপরে বসে গল্প করে। এমন অবস্থায় হঠাৎ অতর্কিত হামলা করে ওমর এসে প্রথমে মামুনকে কোপ মারে এবং অপরাপর আসামীরাও তাকে সহ মামুনকে এলোপাঁতাড়ি মেরে ফেলে যায়।

এমনকি আজিজ জানায়, ঘটনার দিন দুপুরে এক নেতা মামুনকে ফোন করে এবং ঔদিন মামুন যে ডাঙ্গামার্কেট বাজারে সেলুনে বসা আশিককে একটা তাপ্পড় মেরেছিল। সে বিষয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় বলে মামুনেই সেদিন আজিজকে জানায়। অন্যদিকে এ হত্যাকান্ডে দুটি বিষয় সামনে আসে। একটি হলো এলাকায় মাদক প্রবণতা বেড়ে যাওয়া ও সেবনকারীদের বিরুদ্ধে মামুন প্রতিবাদী হয়ে সোচ্চার হয়ে আশিককে মারধর করলে এ ঘটনার সুত্রপাত হয়। এমনকি আহত আজিজ ও তা জানান। মামুন চেয়েছিলেন এলাকার যুবকেরা মাদকে নষ্ট না হয়। বরং সেটাই তার কাল হয়ে দাড়ায়।

অপরদিকে ছাত্রনেতারা ও স্থানীয়রা আরেকটি বিষয় তুলে ধরেন। সেটা হলো দলীয় রাজনীতিতে নানা গ্রুপিং ও দ্বন্ধ। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কিছু নেতাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে পরে সংঘাতে পরিণত হয়। মামুন যেহেতু কর্ণফুলী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন।
সেহেতু সম্ভাব্য অন্য প্রার্থীদের একটি গ্রুপ আশিককে মারার ঘটনাটাকে পুঁজি করে কিলিং মেশিন হিসেবে এলাকার বখাটে কথিত ছাত্রলীগ কর্মীধারী যুবক ওমর, সুমন, আলী আজগর, পারভেজ, মোঃ আলী নুর, আজম ও শাহনূর কে ব্যবহার করে বলে মন্তব্য করেন অনেকে।

এমনটি ধারণাও উড়িয়ে দেওয়া যায়না, যেহেতু মামুন যখন আশিককে একটা তাপ্পড় মারে। তার প্রতিশোধ হিসেবে এজাহার ভুক্ত আসামীরা মামুনের ডান হাত কেটে শরীর থেকে বিছিন্ন করে নেয়। যা লাশের ছবিতে স্পষ্ট। এতে বুঝা যায় কতটা ক্ষিপ্ত ছিলো অপরাধীরা। সুুত্রে জানা যায়, এ ঘটনার পিছনে আসামীদের ইন্ধন দেওয়া অনেকেই আছেন যারা এখন এলাকা ছাড়া। যাদের মোবাইল নং বন্ধ কিংবা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। যাদের অনেকে প্রভাবশালী ও এলাকায় বড় নামে, পরিচিত।

এদের সাথে অপরাধীদের এখনো যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করছে নিহতের পরিবার। কেননা আসামীরা সকলে তেমন স্বচ্ছল নয়। তারা আর্থিক সংকটে পড়ে এসব বড় ভাই ও ইন্ধনদাতাদের সাথে যোগাযোগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও পুলিশি তদন্ত ছাড়া তা বের করা সম্ভব না। আদালতে ওমরের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসা দুজন অপরাধী হলো পারভেজ ও মামুন। যারা বর্তমানে পলাতক রয়েছে বলে এলাকাসুত্রে জানা যায়। তবে পুলিশ অতি দ্রুত আসামী মোঃ ওমর উদ্দিনকে গ্রেফতার করতে সামর্থ্য হন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমীরপুর গ্রামের জমাদর পাড়ায় বাড়ির অদুরে দুর্বৃত্তদের এলোপাতাড়ি ধারালো অস্ত্রের কোপে ছাত্রলীগ নেতা মামুন আল রশিদ (২৪) খুন হন।

এ ঘটনায় পরের দিন নিহতের বড়ভাই মোঃ ইয়াছিন বাদি হয়ে কর্ণফুলী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পাঁচ নেতাকর্মী মোঃ আলী নুর, আজম, আলী আজগর, ওমর ও শাহনূর সহ অজ্ঞাত আরো ৫/৬জনকে আসামি করে।
মামলার বাদি ইয়াছিন কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, ২৪ দিন পেরিয়ে গেছে। প্রধান আসামিরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। আমি সকল আসামীদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবী জানাই। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম বোরহান উদ্দিন বলেন, জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতার করে দ্রুত শাস্তি দাবি করছি।’

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্ণফুলী থানার (ওসি তদন্ত ) মোঃ ইমাম হাসান বলেন, প্রধান আসামী ওমরকে গ্রেফতার করে তার জবানবন্দি নিয়েছে আদালত। তাতে আরো কয়েকজনের নাম এসেছে সুতরাং বাকি মূল আসামীদের ধরার চেষ্টায় রয়েছে পুলিশ। আশা করি দ্রুত সময়ে গ্রেফতার হবে। সর্বশেষ গতরাত সাড়ে ৮টায় মামুন হত্যার প্রতিবাদে উপজেলার শাহমীরপুর বাদামতল এলাকায় কয়েক ঘন্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয়রা। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে আসামিদের দ্রুত গ্রেফতারের আশ্বাসে সড়ক অবরোধ তুলে নেয়।