ডানা মেলেছে পায়রা সমুদ্র বন্দর, বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

জাহিদ রিপন, পটুয়াখালী প্রতিনিধি: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সংগতি রেখে দেশের সমুদ্রবন্দর কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নে রাবনাবাদ চ্যানেলের তীরে নির্মিত হচ্ছে দেশের তৃতীয় সমৃদ্র বন্দর পায়রা। বিদ্যমান দুটি বন্দরের পাশাপাশি তৃতীয় একটি বন্দর নির্মান করে বিশেষ একটি অর্থনৈতিক অ ল গড়ে তুলতে নেওয়া হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী ও চতুর্মুখী পরিকল্পনা। ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মহাপরিকল্পনা নিয়ে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর সংসদে পাস হয় পায়রা বন্দর অধ্যাদেশ-২০১৩। একই বছর ১৯ নভেম্বর বন্দরের ভিত্তি ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পায়রা বন্দরই হবে জাতীয় অগ্রগতির চালিকাশক্তি এমন অর্থনৈতিক মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে দেয়া হয়েছে ব্রিটেন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এইচআর ওয়েলিংফোর্ডকে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তি হয় সংস্থাটির। সমীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক মূল বন্দরের কাজ, নদী শাসন, চ্যানেল ডিজাইন, জাহাজের নাব্যতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ড্রেজিংয়ের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে। তিন পর্বে এই নির্মাণ পরিকল্পনায়, প্রথম পর্বের ১৯ ধাপের প্রথম পর্যায় খরচ হয়েছে এক হাজার ১২৮ কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় পর্যটন শিল্প বিকাশে বিশেষ অঞ্চল নির্মান, উপকূলীয় অ লে সবুজ বেষ্টনীসহ বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তোলা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। থাকবে কয়লা টার্মিনাল। গড়ে তোলা হবে জাহাজ নির্মাণ শিল্প এবং বিশেষ রপ্তানি অঞ্চল। বন্দর সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখানে তৈরি হবে তেল শোধনাগার, সার কারখানা। আকাশপথে যোগাযোগের জন্য বিমানবন্দর র্নিমানসহ চলমান রয়েছে নৌবাহিনীর ঘাঁটি বিএনএস শের-এ-বাংলা’র র্নিমান কাজ। পর্যায়ক্রমে এটি গভীর সমুদ্রবন্দরের রূপ নিয়ে চার লেনের মহাসড়ক ও ডাবল গেজ রেললাইনে যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণভাবে চালু হবে ২০২৩ সালে। বন্দরের পাশেই গড়ে উঠবে এলএনজি টার্মিনাল। ২০১৬ সালের ১৩ আগষ্ট কৃত্রিম প্রোতাশয়ের এই বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পায়রা বন্দর নির্মাণে স্বল্পমেয়াদী কার্যক্রম শেষে এখন চলছে মধ্য মেয়াদী কার্যক্রম। এরপরে শুরু হবে শেষ পর্যায়ের দীর্ঘ মেয়াদী কার্যক্রম। বন্দর সূত্র নিশ্চিত করে, ২০২৫ সালে ৬০বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য মেটানো সম্ভব হবে এ বন্দর থেকে। মংলা ও চিটাগং বন্দরের চেয়ে পণ্য খালাশ করতে পায়রা বন্দর ব্যবহারে প্রতি টণ পণ্যে কমপক্ষে ছয় ডলার খরচ কম হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটা নির্ভরশীল থাকবে পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে। এপর্যন্ত এ বন্দর থেকে ২০টি জাহাজ পণ্য খালাশ করায় সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। এছাড়া বন্দর আয় করেছে প্রায় তিন কোটি টাকা।

বন্দর সূত্রে জানা যায়, ভূমি উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত করে ১৬ একর জায়গায় বন্দরের বাউন্ডারি দেয়ালের কাজ শেষ হয়েছে। পাঁচ তলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে। নির্মিত হয়েছে দৈনিক দুই হাজার টন নিরাপদ পানি সরবরাহ সম্বলিত পানি শোধনাগার, কাস্টমসসহ নিরাপত্তা ভবন, নদীর পাড় ঘেঁষে অস্থায়ী অফিস ভবন। স্থাপিত হয়েছে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাশের টার্মিনাল, বেইলি ব্রিজসহ সংযোগ সড়ক। সোলার বাতিসহ বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সাবমেরিন কেবল সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। সাগর মোহনা থেকে মূল চ্যানেলের নেভিগেশনাল বয়া স্থাপন করা হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে সীগন্যাল বাতি।

সাগর থেকে চ্যানেলের ইনার সাইটে ২৮টি বয়াবাতি সেট করা হয়েছে। রামনাবাদ থেকে তেতুলিয়া নদীতে বরিশাল হয়ে ঢাকার মেঘনা নদীর হিজলা পর্যন্ত প্রায় ২০ নটিক্যাল মাইল নদী খনন করা হয়েছে। যেখানে পাঁচ মিটার নাব্যতা বজায় রাখা হয়েছে। এ চ্যানেলেও ৪৬টি বয়াবাতি স্থাপন করা হয়েছে। চ্যানেলটিতে ১০ মিটার নাব্যতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে বেলজিয়ামের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। যা শীঘ্রই বাস্তবায়ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৩৩ মিটার দীর্ঘ জাহাজ পণ্য নিয়ে মূল চ্যানেলে প্রবেশ করে খালাশ করেছে। সাগরের প্রবেশদ্বার থেকে রামনাবাদ মূল চ্যানেল অভ্যন্তরে শত শত জাহাজ অবস্থানের সুযোগ রয়েছে।

বন্দর সংলগ্ন ট্রাক স্টান্ডের জন্য প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। বন্দর সার্ভিস সুবিধার জন্য বিভিন্ন ধরনের জলযান (হাই-স্পিড) নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। চালু হয়েছে সিএন্ডএফ এজেন্ট ক্লিয়ারেন্স এবং ইমিগ্রেশনের কাজ। ইতোমধ্যে ৬২ জন বিদেশী নাগরিকের ইমিগ্রেশন সুবিধা দেয়া হয়েছে এ বন্দর থেকে।

আপাতত সড়ক ও রেলপথ ছাড়াই নৌপথে পণ্য আনা-নেওয়ার মধ্য দিয়েই চালু হচ্ছে বন্দরটি। শুরুতে মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে নৌপথে পণ্য পরিবহন হবে। এ জন্য লালুয়ার চারিপাড়া পয়েন্টে পন্টুন (জেটি) স্থাপন করা হয়েছে। বন্দর-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নৌপথে ঢাকা থেকে উভয় বন্দরের দূরত্ব প্রায় সমান আড়াই শ কিলোমিটার। বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য কমপক্ষে ৯ মিটার গভীরতা দরকার হয়, সেখানে রামনাবাদ চ্যানেলে জোয়ারের সময়ও ১৪ মিটার পানি থাকে।