পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় রাঙ্গাবালী, যোগাযোগ সমস্যা ঘিরেই সব সংকট

জাহিদ রিপন, পটুয়াখালী প্রতিনিধিঃ সবুজ ঘন বনাঞ্চল। পাখির কোলাহল। আর সমুদ্রের জলরাশি। সৈকতের তটরেখায় লাল কাঁকড়াদের ছুঁটোছুঁটি। ঢেউয়ের তালে, দুলে জেলে নৌকার বহর। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে সি-বীচে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্যতো আছেই।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় এমন নানা সৌন্দর্য ঘেরা আকর্ষণীয় সোনারচর ও জাহাজমারা’র দৃশ্য সৌন্দর্য্য পিপাসু পর্যটকদের মন নিশ্চয়ই আকৃষ্ট করে। তবে সম্ভাবনা থাকা সত্বেও কেবলমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে রয়েছে পিছিয়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেই পর্যটনের ব্যাপক বিকাশ ঘটবে। অর্থনৈতিক অবস্থারও অমূল পরিবর্তন হবে। সোনারচর বঙ্গোপসাগরের কোলজুড়ে বেড়ে ওঠা সৌন্দর্যের লীলাভূমি সোনারচর। উত্তর- দক্ষিণ লম্বালম্বি এ দ্বীপটি দূর থেকে দেখতে অনেকটা ডিমের মতো। সকাল কিংবা শেষ বিকেলের রোদের আলো যখন সোনারচরের বেলেভূমিতে পরে, তখন দূর থেকে পুরো দ্বীপটাকে সোনালি রঙের থালার মতো মনে হয়। বালুর ওপরে সূর্যের আলোয় চোখের দৃষ্টি চিকচিক করে। মনে হবে যেন কাঁচা সোনার প্রলেপ দেয়া হয়েছে দ্বীপটিতে। ধারণা করা হয়, বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই দ্বীপটির নাম সোনারচর রাখা হয়েছে। সমুদ্রের যেকোন জায়গায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখা যায়। এটি রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নের আওতাধীন। এখানে রয়েছে পাঁচ হাজার একরের বিশাল বনভূমি। মন:মুগ্ধকর সৌন্দর্যের নানা রকম প্রাকৃতিক আয়োজন রয়েছে এ দ্বীপটিতে। রয়েছে সমুদ্র উপভোগের সুযোগ। ঢেউয়ের তালে সমুদ্র স্নানেও রয়েছে ভিন্ন আমেজ। এখানে গেলে দেখা মিলবে হাজারো জেলের। সাগর থেকে তুলে আনা টাটকা মাছের স্বাদও নেয়া যাবে এখান থেকে। এছাড়া শীত মৌসুমে গড়ে ওঠে অস্থায়ী শুঁটকি পল্লী। এ সময় পর্যটকরা আসলে শুঁটকি পল্লী ঘুড়ে বেড়ানো যাবে। দূর থেকে সমুদ্র সৈকতের বীচে তাকালেই লাল কাঁকড়ার চোখে পড়বে। দেখলে মনে হবে যেন লাল চাদর বিছিয়ে রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, অসংখ্য হরিণ আর বানর রয়েছে সোনারচরে। এছাড়া বনাঞ্চলের কাছাকাছি গেলে সহজেই চোখ পড়বে বুনো মোষ, শুকর, বানর, মেছো বাঘসহ আরও সব বন্য প্রাণী। দেশী-বিদেশী দূর্লভ প্রজাতির নানা রঙের পাখির সমারহ। শীত মৌসুম এলেই উত্তর বঙ্গোপসাগর তীরে সোনারচরে অভয়ারণ্যে ওদের সমাগম ঘটে। কলকাকলিতে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরে উঠেছে সোনারচর। কেউ ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে, কেউ আবার ঝুটি বেঁধে। কেউ একা এদিক ওদিক ছুটোছুটিতে ব্যস্ত। প্রতিবছরই শীত মৌসুমে সোনারচরে আশ্রয় নেয় ওইসব পাখি। এসব দেখতে হলে প্রভাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে নৌকা নিয়ে। সোনারচরে রাত কাটানোর মতো নিরাপদ আরামদায়ক কোন ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। রয়েছে বন বিভাগের ক্যাম্প। সেখানে কিছুটা কষ্ট হলেও রয়েছে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। এছাড়া চাইলে সূর্যাস্ত দেখার পর ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে ৩০ মিনিটে চলে যেতে পারেন চর মোন্তাজে। সেখানে রয়েছে বেসরকারি সংস্থা স্যাপ বাংলাদেশ ও মহিলা উন্নয়ন সমিতির ব্যবস্থাপনায় রাত যাপনের মতো ভালো সুবিধা সম্পন্ন বাংলো। এছাড়া রয়েছে কয়েকটি হোটেল। জাহাজমারা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে জেগে আছে নয়নাভিরাম জাহাজমারা সমুদ্র সৈকত। শেষ বিকেলে দিগন্ত রেখায় সূর্যাস্তের দৃশ্য। ভোরে কুয়াশার আভা ভেদ করে পুব আকাশের বুক চিরে লাল সূর্য ওঠা। এরই মাঝে সকাল- দুপুর-বিকেল পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা দ্বীপ। রয়েছে নিবিড় সবুজের সমারোহ। সৈকতে অগণিত লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। তবে এখন পর্যন্ত এখানে লোক বসতি গড়ে ওঠেনি। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে এ দ্বীপের অবস্থান। আর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে দক্ষিণ- পশ্চিমে এটির দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে পর্যটকেরা এখানে আসে প্রশান্তির খোঁজে। অথচ এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও এখনো গড়ে ওঠেনি কোন যাতায়ক ব্যবস্থা। পর্যটকদের যাতায়াত সহজতর করতে পারলে সরকার আয় করতে পারবে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। সরকার এটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা না করলেও পর্যটকরা আসছে এখানে। ধ্বংস করছেন দ্বীপের সৌন্দর্য। পর্যটনকে কেন্দ্র করে দ্বীপের নির্দিষ্ট স্থানে পর্যটকদের ভ্রমণের সুযোগ করে দিলে বাঁচবে পরিবেশ। ১৯৭৪-৭৫ ও ২০০৭-০৮ সালে বন বিভাগ দুই দফায় এই দ্বীপের ৫০০ একর বিস্তীর্ণ বনভূমিতে কেওড়া, ছইলা, গেওয়া, বাবলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বনায়ন করে। যা দূর থেকে দেখলে মনে হয় সাগরের বুক জেগে উঠছে এক সবুজ বনভূমি। এই দ্বীপের মূল বাসিন্দাই হচ্ছে লাল কাঁকড়া। যাদের উপস্থিতিতে সমুদ্রের রূপালি সৈকত যেন রক্তিম হয়ে ওঠে। জনমানব শূন্য দ্বীপে হঠাৎ করে মানুষের উপস্থিতি ঘটলে এদিক ওদিক ছুটতে থাকে কাঁকড়াগুলো। দ্রুত আশ্রয় নেয় গর্তে। আবার অনেক কাঁকড়া ব্যস্ত হয়ে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করে বালুর ভেতরে। মানুষের আনা-গোনায় দ্বীপে লাল কাঁকড়ারা নিরাপদ নেই। এদের নিরাপদ আবাসভূমি হুমকির মুখে পড়েছে।

সমুদ্রের ঢেউ আর সবুজ প্রকৃতি এ এলাকার পরিবেশকে করে তুলেছে মোহনীয়। জাহাজমারার স্থানীয় লোকজন জানালেন, মৌসুমে অনেক কষ্ট করে এখানে কিছু লোকজন বেড়াতে আসেন। অনেকে আবার আসেন পিকনিক করতে। সড়ক পথে যাতায়াতে সমস্যা বলে এখানে দূরের লোকজন আসেন ট্রলারে করে। সুযোগ করে দিলে এই নির্জনে বহু পর্যটক আসতে পারবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকার সদরঘাট থেকে একটি লঞ্চ রাঙ্গাবালীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। ঢাকা থেকে সন্ধ্যা ৬ টায় লঞ্চে যাত্রা শুরু করলে পরদিন দুপুর ১১ কিংবা ১২ টায় কোড়ালিয়া লঞ্চঘাট পৌঁছায়। সেখান থেকে সোনারচর কিংবা জাহাজমারা যাওয়া যায়। সোনারচর যেতে হলে উপজেলা সদর থেকে সড়ক পথে ৪ কিলোমিটার পেড়িয়ে গহিনখালী লঞ্চঘাট। সেখান থেকে নদী পথে লঞ্চ কিংবা খেয়াযোগে প্রায় একঘন্টার নৌপথ পাড়ি দিয়ে চরমোন্তাজ ইউনিয়ন। চরমোন্তাজ থেকে রিজার্ভ ভাড়ায় জেলে ট্রলার যোগে প্রায় আরো একঘন্টার পথ পেড়িয়ে দেখা মেলে সোনারচরের। উপজেলা সদর থেকে সড়ক পথে ২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে খালগোড়া খেয়াঘাট। সেখান থেকে চরগঙ্গা হয়ে সড়কপথে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ পেড়িয়ে জাহাজমারা সমুদ্র সৈকত। এছাড়া নৌপথেও যাওয়া যেতে পারে। উপজেলা সদর থেকে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ভাড়া করে যাওয়া যাবে। তবে সময় লাগবে প্রায় তিন ঘন্টা। সমাধানে যা করা দরকার রাঙ্গাবালী উপজেলাকে পর্যটনমুখী করতে আগে দরকার যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন। সারাদেশের সঙ্গে রাঙ্গাবালীকে সড়ক যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এটা করতে হলে পার্শ্ববর্তী গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি থেকে রাঙ্গাবালী উপজেলার কোড়ালিয়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু করা প্রয়োজন। তাহলে সড়কপথে রাঙ্গাবালী আসা সম্ভব। আর কুয়াকাটা থেকে সেনারচর ও জাহাজমারা পর্যন্ত সি-ট্রাকের ব্যবস্থা।

একইভাবে রাঙ্গাবালী উপজেলা থেকেও সি-ট্রাকের ব্যবস্থা করা দরকার। এই পথগুলোতে সি-ট্রাক চলাচল করলে পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধা বাড়বে। পাশাপাশি নিয়মিত সি-ট্রাক চালু হলে এইসব এলাকার লাখো মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে সূচনা হবে নতুন দিগন্তের। একইসঙ্গে হোটেল-মোটেলসহ রেস্ট হাউস তৈরি করলে পর্যটকদের এসব দ্বীপে আসার আগ্রহ আরো বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতে পারে। স্থানীয় চিত্রশিল্পী শাহ আলম বলেন, শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এখানে চাইলেও বাইরে থেকে লোকজন আসতে পারে না। পর্যটন মৌসুমে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলে আর কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেই এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে। তিনি আরও বলেন, পর্যটন বিকাশে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সড়ক পথ তৈরি যে বাধ্যতামূলক তা নয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে সরাসরি লঞ্চ যোগাযোগের ব্যবস্থা করলেও পর্যটকরা আসতে পারেন। অন্তত পর্যটন মৌসুমের কথা বিবেচনায় রেখে এমন ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। পর্যটন বিকাশের মধ্য দিয়ে এ এলাকার উন্নয়ন ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

সোনারচর ও জাহাজমারা ছাড়াও রাঙ্গাবালী উপজেলায় চর তুফানিয়া, রুপার চর, চর হেয়ারসহ আরো বেশ কয়েকটি আকর্ষণীয় দ্বীপ রয়েছে। এসব দ্বীপে পর্যটকদের আগমন বাড়াতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন দরকার। এছাড়া পর্যটকদের অবস্থানের জন্য হোটেল-মোটেল নির্মাণ করা জরুরি। এসব হলে রাঙ্গাবালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার অমূল পরিবর্তন ঘটবে।