কেশবপুরে খেজুর রসের গুড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি, গাছ পুড়ানোর কারণে রস ও গুড় এখন প্রায় বিলুপ্ত

আজিজুর রহমান, কেশবপুর (যশোর) প্রতিনিধি: কেশবপুরে খেজুর রসের গুড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বলে খেজুর গাছ মালিকরা জানান। শীত মৌসুম আসলেই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গাছিরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রস ও গুড়ের সন্ধানে ব্যস্ত সময় পার করে থাকেন। উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে মিনি ইটভাঁটায় খেজুর গাছ পুড়ানোর কারণে রস ও গুড় এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

এদিকে যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কেশবপুর শহরের গুড় হাটায় ক্রেতারা গুড় কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন। গত বছরের তুলনায় এ বছরে খেজুরের রস ও গুড়ের দাম একটু চড়াও হলেও ক্রেতারা গুড় ক্রয় করতে পিছাচ্ছে না। খেজুরের রস খেতে খুব সুস্বাদু। খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন পিঠা। সন্ধ্যা হলে গাঁছিরা রস ঝেড়ে বাজারে এনে বিক্রয় করে থাকেন। আবার ভোর রাতে রস ঝেড়ে তা দিয়ে গুড় তৈরি করেন।

দাঁনাগুড় প্রতি ভাঁড় ১৪/১৫ শত টাকা ও ঝোলা গুড় প্রতি ভাঁড় ৬/৭ শত টাকা দরে বিক্রয় হচ্ছে। ভাল্লুকঘর, মূলগ্রাম, বেলকাটি, সাগরদাড়ি, ফতেপুর, চিংড়া, হাসানপুর, ধর্মপুর, আওয়ালগাতি, ভান্ডারখোলা, দেউলি, বাগদাহ, সাবদিয়া, মজিদপুর, মধ্যকুল, ব্রহ্মকাটি, রামচন্দ্রপুর, ব্যাসডাঙ্গা, পাঁজিয়া, গড়ভাঙ্গা, কলাগাছি, গৌরিঘোনা, ভেরচি, মাগুরখালি, মঙ্গলকোট, বড়েঙ্গা, কন্দর্পপুর, পাথরা, কেদারপুরসহ অনেক গ্রামে ঘুরে দেখাগেছে গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ যেমন ঠিলে-খুংগি-দড়া- গাছি দাঁ বালিধরাসহ ইত্যাদি নিয়ে গাছ কেটেরস সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত রয়েছে।

শ্রমজীবি গাছিরা জানান প্রতি বছরে খেজুর গাছ কর্তনের কারণে রস ও গুড়ের দাম বৃদ্ধি পাচেছ। অনেক গাছের মালিকরা খেজুর গাছ কর্তন করে মিনি ভাঁটায় বিক্রয় করে থাকে। যার ফলে খেজুরের রস ও গুড় বিলুপ্তির পথে দেখা দিয়েছে। মজিদপুর গ্রামের শামছুর রহমান জানান এ বছরে প্রথম ১ শত ২০ টাকা দিয়ে এক ভাড় রস কিনেছি। গত বছরে যার দাম ছিলো ৭০/৮০ টাকা।

রামচন্দ্রপুরগ্রামের ভ্যান চালক শাহাবুদ্দিন জানান আমি গরিব মানুষ হওয়ায় ২ বছর ধরে রস কিনে খেতে পারছি না। এর আগে প্রতি বছরে প্রায় ১০/১২ ভাড়রস কিনতাম। তখন প্রতি ভাড় রসের দাম ছিলো ১৫/২০ টাকা। খেজুর গাছ কর্তনের কারণে রস ও গুড়ের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

মধ্যকুল গ্রামের শাহিনুর রহমান জানান গত বছর আমার এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকার কারণে অনেক খেজুর গাছ মারা গেছে। এবছর জলাবদ্ধতা না থাকায় আমার এলাকায় রসপাওয়া গেলেও দাম অনেক চড়া। খেজুর গাছের মালিকরা জানান একজন শ্রমিককে প্রায় ২/৩ শত টাকা করে দেয়া হয়। যার জন্য রসের দাম বৃদ্ধি হয়েছে। এর আগে প্রতিটি গাছে ১ থেকে দেড় ভাড় রস হতো, এখন এর অর্ধেক হচেছ।

চিরায়ত বাংলার প্রতিটি মানুষের মুখে-মুখে ধ্বনিতহয় শীতের আগমনে। আবহমান বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ব্যাবস্ততা বেড়ে যায় দিগুন। মৌসুমের শুরুতে আলতো শীতের সোনালী সূর্য্যরে রোদেলা সকালে গাছিরা বাঁশের ডগা দিয়ে নলি তৈরীতে ব্যাস্ত সময় পার করে। কেউবা আবার পাটের আশ দিয়ে দড়াতৈরীতে মগ্ন। বেলা বাড়তেই ঠিলে-খুংগি-দড়া- গাছি দাঁ বালিধরা নিয়ে গাছিরা ছুটে চলে গাছ কাটতে। আবার ভোরে উঠে রস নামাতেকূয়াশা ভেদ করে চড়ে বেড়ায় এক গাছ থেকে আরেক গাছে। এর পর ব্যস্ততা বাড়ে মেয়েদের সকাল থেকে দুপুর অবধি কোন ফুসরত নেই দম ফেলার।

এ্যালমুনিয়ামের কড়াইতে রস জালিযে গুড় তৈরী করতে সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত সময় লাগে। জিরেন রস দিয়ে দানাগুড়, ছিন্নি গুলা, পাটালী তৈরী হয়। ঘোলা রস দিয়ে তৈরী হয় ঝুলা গুড়। নলেন রসের পাটালী খেতে খুব সুস্বাদু হয় বলে বাজারে এর কদর অনেক বেশী। কেশবপুরের খেজুরের রসের খ্যাতি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

কেশবপুর, মনিরামপুর থেকে তাজা খেজুরের রসের তৈরী গুড় বাংলাদেশের প্রত্যেক অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। পাশা-পাশি আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারত, মায়ানমারসহ পৃথিবীর কয়েকটি দেশে কেশবপুরের খেজুরের গুড়ের ব্যাপক কদর রয়েছে। যশোর তথা কেশবপুরকে সারা পৃথিবীতে পরিচিত করেছে যে কয়টি বিষয় তার মধ্যে যশোরের কেশবপুরের খেজুরের রস অন্যতম একটি।

কেশবপুরের খেজুরের রসের গুড়র বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। শীত আসলেই আবহমান বাংলার ঘরেঘরে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। প্রতি ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠা তৈরীর জন্য ঢেঁকিতে চাউলের গুড়া তৈরীর মহোৎসব। বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে সন্ধা হলেই একদিকে শুরু হয় কবি গান অন্য দিকে সন্ধে রস দিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন প্রকার পিঠা পুলিসহ পায়েশ তৈরীর ধুম।