বঙ্কিম চন্দ্র-দেবী চৌধুরাণী কলেজ-একই সুত্রে গাঁথা, ইতিহাস জানতে ষ্টার জলসায় দর্শক ঠাসা ঠাসা

সময় অনেক গড়িয়ে গেছে, রংপুর -৪ আসনের পীরগাছা বাসী টিপু মুন্সিকে বানিজ্য মন্ত্রী হিসেবে পেয়ে আনন্দিত এবং গৌরবান্বিত। দেবী চৌধুরাণী কলেজটিকে জাতিয়করনেরর তালিকায় নিয়ে আসার সম্ভাবনা আরও দৃঢ় ও শক্ত এবং প্রবল হয়েছে এলাকাবাসীর মনে, কারন স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর অবহেলিত পীরগাছা বাসী একমাত্র পূর্ণ বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে পেয়েছেন জনাব টিপু মুন্সিকে। এই কল্পণার পাখায় ভর করে এমন আশা করতেই পারেন।

এলাকাবাসীর এরকম আশা পোষণ করা-আজ থেকে দশ বছর পূর্বে ছিল অকল্পনীয় ও আশায় গুড়ে বালি। এখন এলাকাবাসীর মনে একটা কথাই শুনতে পাওয়া যায় ” বাহে হামার আর সেই দিন নাই। হামরা বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুন্সির এলাকার লোক। হামরা মন্ত্রীর কাছত বায়না ধরবার নই, তা কাই ধরবে ব্যাহে? এমনই জোড়ালো দাবী এখন রংপুর-৪ আসনের দেবী চৌধুরাণী এলাকার ভোটারদের।

দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজ শুধু কলেজই নয় মানবতার নারী” দেবী চৌধুরাণীর”প্রাণবন্ত ইতিহাসের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। বঙ্কিমচন্দ্রের অমর কাহিনী অবলম্বনে লেখা দেবী চৌধুরাণীকে আরও প্রাণবন্ত, চাঙ্গা ও স্বরণীয় করে রাখতে এবং পরবর্তী প্রজন্মকে জানান দিতে স্বানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ববর্গ প্রতিষ্ঠা করেন দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজ। এই কলেজটির প্রতিষ্ঠার পিছনে যাঁরা নায়কের ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রাক্তন ডিন এবিএম মফিজুল ইসলাম পাটোয়ারি, শাহ্ মোঃ ইলিয়াছ আলী মন্ডলসহ আরো অনেকে।

তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্কিমচন্দ্রের সম্মানার্থে ও দেবী চৌধুরাণীকে প্রাণবন্ত করে রাখার জন্য ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়” দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজ`। এলাকা ঘুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, দেবী চৌধুরাণীর ইতিহাসকে জানতে ভারতীয় টিভি চ্যানেল “ষ্টার জলসায় ” দর্শকদের উপচে পড়া ভীড়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট এলাকাবাসীর দাবী একটািই দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজটিকে জাতিয়করন করা।

রংপুর বিভাগীয় শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার পূর্ব- দক্ষিনে পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ী ইউনিয়নের মকসুদ খাঁ গ্রামে দেবী চৌধুরাণীর বাড়ী অবস্হিত।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইংরেজ পরাধীনতার বিরুদ্ধে দেশের উত্তর জনপদের ইতিহাসখ্যাত ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের স্বাধীনতা সংগ্রামী মজনু শাহ ও ভবানী পাঠক এর অনুসারি দেবী চৌধুরানীর স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন সংরক্ষিত না হওয়ায় এখন বিলুপ্তির পথে। অথচ ১৭৬০ সাল থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত রংপুরের পীরগাছা, মিঠাপুকুর, কাউনিয়া, গাইবান্ধার বামনডাঙ্গা, দিনাজপুরের করতোয়া নদী তীরবর্তী ঘোড়াঘাট এলাকাসহ বগুড়ার নদীবেষ্টিত এসব এলাকা জুড়ে ইংরেজদের অন্যায় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিদ্রোহ।

স্বামী পরিত্যক্ত দেবী চৌধুরানী যে এলাকায় বসবাস করে ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে কর্মতৎপর ছিলেন সেটি হচ্ছে রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার কৈকুড়ি ইউনিয়নের মকসুদ খাঁ গ্রাম। বিদ্রোহী ও সংগ্রামী এবং মানবতার নারী দেবী চৌধুরাণীকে সফল নায়িকা হিসা্বে সম্মান দেখিয়েঝেন, বঙ্কিম চন্দ্র তাঁর লেখা দেবী চৌধুরাণী ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে। তাঁরই ধারাবাহিকতায় দেবী চৌধুরাণীর স্মৃতিকে আরও প্রাণবন্ত করতে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে জানান দিতে অত্র এলাকার গুণী ব্যক্তিত্বগণ প্রতিষ্ঠা করেন দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজ।

দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজের প্রাক্তন এবং প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল শাহ্ নজরুল ইসলাম রাজু বলেন, দেবী চৌধুরাণীর প্রাণবন্ত ইতিহাস কে আরও চাঙ্গা করতে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য তাঁরা হলেন শাহ্ আব্দুল হান্নান মন্ডল, এ বি এম মফিজুল ইসলাম পাটোয়ারী , শাহ ইলিয়াস আলী মন্ডল প্রমুখ। বর্তমান অধ্যক্ষ মোঃ আনোয়ার হোসেন প্রসঙ্গক্রমে বলেন, বঙ্কিম চন্দ্র চট্রপাধ্যায়ের অন্যতম সাহিত্যকর্ম দেবী চৌধুরাণীর স্মৃতিকে ধরে রাখতে দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজকে জাতিয়তরনের জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন। অত্র কলেজের বর্তমান সভাপতি ডালিম মন্ডল বলেন, দেবী চৌধুরাণী ডিগ্রী কলেজ একটি ঐতিহাসিক কলেজ। আমাদের এই কলেজটিকে সরকারি করা হলে-দেবী চৌধুরাণীর ইতিহাস আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন।

প্রসংগক্রমে উল্লেখ্য যে কাউনিয়া-গাইবান্ধা রেলরুটের চৌধুরানী রেলওয়ে ষ্টেশন সংলগ্ন চৌধুরানী বাজার থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১ কি.মি.। এছাড়া রংপুর-সুন্দরগঞ্জ-গাইবান্ধা সড়কও গেছে এই চৌধুরানী বাজারের উপর দিয়েই। ওই সংগ্রামী নারীর নামেই রেলষ্টেশন ও এলাকার নামকরণ করা হয়েছে চৌধুরানী।

সরেজমিনে এলাকাটি পরিদর্শনে দেখা গেছে, দেবী চৌধুরানীর স্মৃতি বিজড়িত সেই ভবন বা তাঁর কোন স্মৃতি চিহ্নের অস্তিত্ব এখন আর নেই। বাঁশ ও জঙ্গলপূর্ণ গাছের পরিত্যক্ত ভিটা, গ্রাম জুড়ে ছোট বড় অনেক পুকুর এবং হারিয়ে যাওয়া সেই ভবন বেষ্টন করে রাখা অতীতের সেই শালমারার খালটিই এখন শুধু দৃশ্যমান।

এছাড়া চৌধুরানী বাজার সংলগ্ন মসজিদের পাশে রয়েছে সেই আমলের বিশাল একটি পুকুর। যাকে দেবী চৌধুরানীর পুকুর নামে আখ্যায়িত করে থাকে স্থানীয় লোকজন। মকসুদ খাঁ গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল হান্নান বসুনিয়া, আব্দুল খলিল মিয়াসহ অন্যান্য গ্রামবাসিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ওই এলাকার যে কোন পুকুর বা কুপ খনন করলেই এখনও পাওয়া যায় পুরাতন বসতবাড়ির অবকাঠামো, প্রাচীন ইট, যা চ্যাপ্টা এবং পাতলা। এমনকি এখানকার কৃষি জমিতেও এক ফুট মাটির নিচেও এখানে প্রায় ১৮ ফুট চওড়া ইটও পাওয়া গেছে। অতীতে লোকজন দেবী চৌধুরানীর স্মৃতি বিজড়িত ভবনগুলোর ইট খুলে নিয়ে গেছে। এমনকি গুপ্তধনের আশায় ভবনগুলো গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে গর্ত খুঁড়ে অসংখ্য পুকুর বানিয়ে ফেলেছে।

প্রসঙ্গত: বাংলার ইতিহাস সুত্রে জানা গেছে, শাহ মজনু মাজযুব নামক এক নেতার অগ্রণী ভূমিকা ছিল ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে। ইংরেজরা তাকে ফকির মজনু শাহ নামে আখ্যায়িত করতো। এই বিদ্রোহ ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে মূলত: বিক্ষুব্ধ বাংলার মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম। যাতে ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী ছাড়াও সম্পৃক্ত ছিলেন বুরহান, মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ, মাদার বকস, নুরুল মোহাম্মদ, রূপানাথ, রামানন্দ গোসাই, অনুপ নারায়ন প্রমুখ।

জানা গেছে, রংপুরের এই বিদ্রোহ দমনে ১৭৫৯ সালে ইংরেজ ক্যাপ্টেন মেকেঞ্জির নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হয়। তাতে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট কিথ মারা যান। যুদ্ধে ফকির মজনু শাহ এর সাথে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীও তার অনুসারিদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। এই বিদ্রোহে প্রায় ৫০ হাজার ফকির সন্ন্যাসী বাংলাদেশের উত্তর জনপদের নদী অঞ্চলে সংঘবদ্ধ হয়ে ইংরেজ ও তাদের ইজারাদার দেবী সিংহসহ দোসরদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। এই প্রত্যক্ষ বিদ্রোহ ইতিহাসে ফকির সন্ন্যাস বিদ্রোহ নামে খ্যাত যা দমনে ইংরেজদের অনেক গলদঘর্ম হতে হয়েছিল।

দেবী চৌধুরানী সম্পর্কে তৎকালিন রংপুরের ইংরেজ কালেক্টর গ্লেজিয়ার তার লিখিত রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন একজন মেয়ে ডাকাত হিসেবে। তাতে বলা হয়েছে, ‘‘দেবী চৌধুরানী নৌকায় বাস করতেন। তাঁর মাইনে করা লেঠেল বরকোন্দাজের এক বিরাট ডাকাত দল ছিল’’। শুধু তাই নয়, দেবী চৌধুরানীর শিক্ষাগুরু ও অভিভাবক ওই এলাকার ভবানী পাঠক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হলেও তাকে ইংরেজরা ডাকাত নামে আখ্যায়িত করতো।

এ প্রসঙ্গে ভবানী পাঠকের কথায়,‘‘ইংরেজদের দুঃশাসনে দেশে চলছে অরাজকতা। রাজ্য শাসন নাই, দুষ্টের দমন নাই। আমরা তাই দেবী চৌধুরানী নামের রাণী করিয়া রাজ্য শাসন চালাইতেছে। তাহার নামে দুষ্টের দমন করি, শিষ্টের পালন করি। এটা কোন অধর্ম নয়’’।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রংপুরে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে ইংরেজ শাসনামলে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি লেখক এবং একজন ইতিহাস গবেষক হিসেবে রংপুরের দেবী চৌধুরানীর জীবনভিত্তিক একটি উপন্যাস রচনা করেন। যাতে তৎকালীন নারী হিসেবে এবং দেশের মানুষের জন্য দেবী চৌধুরানীর জীবন সংগ্রামের দু’টি ভিন্ন ধারার চিত্র ফুটে উঠেছে।

বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাস সুত্রে জানা যায়, দেবী চৌধুরানী ছিল দুর্গাপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী প্রফুল্লমুখী। তাঁর বিয়ে হয়ে ছিল তাদের বাড়ী থেকে ছয় ক্রোশ দুরের ভূতনাথ গ্রামে। ধনী পরিবার হরবল্লভের একমাত্র সন্তান ব্রজেশ্বরের সাথে। যা মূলত: রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ভূতছড়া গ্রাম। রংপুর ও কাউনিয়ার মাঝামাঝি বর্তমান রেলষ্টেশন মীরবাগ যার আগে নাম ছিল ভূতছড়া।

দারিদ্রতার কারণে প্রফুল্ল শ^শুরবাড়ী থেকে বিতাড়িত হয়ে নিজবাড়ীতে অবস্থান করছিলেন। সে সময়ে তারসাথে বসবাসকারী ফুলমনির সহযোগিতায় ওই গ্রামের জমিদার পরান চৌধুরীর গোমস্তা দূর্লভ চক্রবর্ত্তী তাকে রাতে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাতের ভয়ে ভবানী পাঠক অধ্যুষিত এলাকার গভীর জঙ্গলে পালকীসহ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

একাকী ভীতসন্ত্রস্থ পথহারা প্রফুল্ল গভীর জঙ্গলের ভগ্নপ্রায় একটি বিশাল ভবনে রোগাক্রান্ত মৃতপ্রায় বৃদ্ধ কৃষ্ণ গোবিন্দের কাছে আশ্রয় লাভ করে। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর তার ইচ্ছায় সংরক্ষিত কুড়ি কলস ভর্তি মাটিতে পুঁতে রাখা গুপ্তধন লাভ করেন। দেবী চৌধুরানী স্মৃতি বিজড়িত সেই গ্রামটি হলো রংপুরের পীরগাছা উপজেলার চৌধুরানী ষ্টেশন সংলগ্ন মকসুদ খাঁ গ্রাম।

যে গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভবানী পাঠকের যেখানে সংস্পর্শে এসে সুশিক্ষা লাভ করেন এবং কঠোর নিয়ম কানুনের মধ্যদিয়ে যুদ্ধ কৌশল শেখেন। এ সময় প্রফুল্ল স্বাধীনতা সংগ্রামীতে পরিণত হন এবং দেবী চৌধুরানী নামে ভবানী পাঠকের সাথে ইংরেজ খেদাও অভিযানে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।

প্রাপ্ত গুপ্তধন এবং ইংরেজদের দোসর জমিদার ইজারাদারদের নিকট থেকে ডাকাতিলব্ধ সম্পদ অকাতরে এলাকার গরীব দুঃখিদের মধ্যে দান করে মানুষের কাছে দেবীর মর্যাদা লাভ করেন। ইংরেজরা অবশ্য দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠকসহ অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামী ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করে অপপ্রচারে লিপ্ত হন।

বৃদ্ধ কৃষ্ণ গোবিন্দের গুপ্তধন প্রাপ্তি সম্পর্কে বঙ্কিম চন্দ্রের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, উত্তর বাংলায় নীল ধ্বজবংশীয় রাজাদের রাজধানী ছিল। তাদের এ এলাকাসহ অনেক স্থানেই রাজভবন ছিল। চৌধুরানীর মকসুদ খাঁ গ্রামে এ এলাকায় ছিল তেমনি একটি রাজভবন। যেখানে রাজারা বৎসরে কোন এক সময়ে কিছু সময়ের জন্য বসবাস করতেন। এই বংশের শেষ রাজা নীলাস্বর দেব এর সময়কালে গৌড়ের বাদশাহ তার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন।

গৌড়ের বাদশা তার পাঠান সেনাপতিকে পাঠান নীলাস্বরের বিরুদ্ধে। কথিত আছে নীলাস্বর তার ধন সম্পদ রক্ষায় সঙ্গোপনে মকসুদ খাঁ গ্রামের এই রাজ ভবনে মাটির নীচে বিশেষ কুঠরীতে পুঁতে রাখে। গৌড়ের বাদশাহ পাঠান সেনাপতি রাজা নীলাস্বরকে পরাজিত করে তাকে আটক করে। এতে তার সেই ধন সম্পদ মাটির নিচেই পোতা থাকে। কৃষ্ণ গোবিন্দ ভগ্নপ্রায় ওই ভবনে আশ্রয় নিয়ে গুপ্তধন লাভ করেন।

জানা গেছে, তৎকালিন জনসাধারণের শ্রদ্ধা ভালবাসা এবং জনসমর্থনের কারণেই ইংরেজরা দেবী চৌধুরানীকে মেয়ে ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করলেও শত চেষ্টা করেও তাকে আটক করতে পারেনি। কারণ কোন মানুষের কাছেই তার সম্পর্কে সেসময় কোন তথ্য বা প্রকৃত পরিচয় বের করা সম্ভব ছিল না। তবে ইতিহাস অনুসন্ধানী অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখিত প্রফুল্ল নয় বরং দেবী চৌধুরানী ছিলেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার জয়দূর্গাদেবী (ব্রাহ্মনাদেবী) নামের শিবুকুণ্ঠিরাম (বামনপাড়া বা ভুতছড়া) গ্রামের ব্রজ কিশোর রায় চৌধুরী ও কাশিশ্বরী দেবীর মেয়ে।

পীরগাছার জমিদার নারায়ন চন্দ্র চৌধুরীর সাথে তার বিয়ে হয় এবং সন্যাস বিদ্রোহের সময় তিনি জমিদার ছিলেন। তবে ইংরেজ সরকারের তৎকালিন দলিল দস্তাবেজে তিনি যে জমিদার ছিলেন কিনা বা এতে তার সম্পৃক্ততার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এতদঞ্চলের মানুষের কাছে প্রফুল্লই যে দেবী চৌধুরানী ছিলেন সেটাই আজও সর্বজন স্বীকৃত।

উল্লেখ্য যে, তবে ১৭৮৩ সালে দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ‘‘রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’’ এর সাথে ওই জয়দুর্গা দেবীর সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া যায়। বাংলার ইতিহাস (১৭৬০-১৯০৫) সুত্রে জানা গেছে, ইংরেজ গর্ভণর ওয়ারেন হেষ্টিস অনুগত এতদাঞ্চলের ইজারাদার দেবী সিংহের দৌরাত্বের বিরুদ্ধে নুরুদ্দিনের নেতৃত্বে এই কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। যা প্রথমে শুরু হয়েছিল রংপুরের লালমনিরহাট কুড়িগ্রাম এলাকার কাজীরহাট, কংকনিয়া ও টেপাই এলাকায়। কুচবিহারের কৃষকরাও এতে যোগ দিয়েছিল।

কৃষকরা নেতা নুরুদ্দিনকে নবাব উপাধিতে ভূষিত করে। সে সময় বিদ্রোহের ব্যয় নির্বাহে ‘‘ডিঙ্গাবাচা’’ নামক বিশেষ করও আদায় করা হতো। জয়দুর্গা নামের মহিলা জমিদার বিদ্রোহী কৃষকদের প্রতি সহানুভুতিশীল হলেন এবং তিনি কৃষকদের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।

লেখকঃ শেখ মোঃ শফিকুল আলম সরকার (শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিষ্ট)