কেশবপুরে সাগরদাঁড়িতে মধুমেলা উদ্ধোধন করবেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য

আজিজুর রহমান / সোহানা ফেরদৌস সুইটি, কেশবপুর: কেশবপুরে সাগরদাঁড়িতে আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে ৭ দিন ব্যাপী মধুমেলা।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহানায়ক অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা মহাকবি মাইকেল মধূসূদন দত্তের ১৯৫ তম জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষ্যে আগামীকাল ২২ জানুয়ারী মঙ্গলবার বিকালে ফিতা কেটে মধুমেলার শুভ উদ্ধোধন করবেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এমপি।

৭ দিন ব্যাপী মধুমেলা উপলক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ও উপজেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্বাবধানে আধুনিক রুপে সেজেছে মধুমেলার মাঠ। এ বছর সরকারি টেন্ডারের মাধ্যমে মেলার ইজারা দেয়া হয়নি। যার কারণে মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মিজানূর রহমানের কার্র্যালয় থেকে বিভিন্ন স্টল মালিকরা ডাকের মাধ্যমে জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে।

মেলা উদ্ধোধনের পর সন্ধ্যায় মধুমঞ্চে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে যশোর জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা সাধন কুমার দাস ও সহকারী শিক্ষা অফিসার মাসুদুর রহমানের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখবেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য।

বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখবেন সংসদ সদস্য ইসমাত আরা সাদেক, শেখ আফিল উদ্দীন, মোঃ নাসির উদ্দীন, কাজী নাবিল আহমেদ, রণজিৎ কুমার রায়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ নাসির উদ্দিন আহমেদ, যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুল আওয়াল, বিপিএম, পিপিএম পুলিশ সুপার মঈনুল হক, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদার, কেশবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এইচ এম আমির হোসেন, পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম, দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র সাংবাদিক শ্যামল সরকার।

অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখবেন যশোর ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ রবিউল আলম, যশোর প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, যশোর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ডি এম শাহিদুজ্জামান, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এ্যাডঃ মাহমুদ হাসান বুলু, কেশবপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এসএম রুহুল আমীন, বিজ্ঞ পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডঃ রফিকুল ইসলাম পিটু, উপজেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি তপন কুমার ঘোষ মন্টু, মাইকেল মধুসূদন ইন্সটিটিউশনের প্রাক্তন সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম, সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মোস্তাফিজুল ইসলাম মুক্ত, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রাক্তন সহ-সভাপতি জয়দেব নন্দী, প্রাক্তন উপ গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক দেবাশীষ আইচ।

এছাড়া স্বাগত বক্তা হিসাবে বক্তব্য রাখবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মিজানূর রহমান। মধু মেলা উদ্ধোধনের আগে মধু মঞ্চে শিল্পগোষ্ঠী, মধু খেলাঘর, নৃত্যের তালে তালে, নজরুল সাংস্কৃতিক একাডেমি, কলতান সংগীত একাডেমি, মধুসূদন পাবলিক লাইব্রেরি কেশবপুরের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সন্ধ্যায় অতিথিদের আলোচনা সভা শেষে মধু মঞ্চে নাটক, যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন থেকেই প্রতিদিনই মধুমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে কবির জীবনী সম্পর্কিত আলোচনা সভা। মধুসূদনের সৃষ্টি, সাহিত্য ও কর্মজীবনের উপর বিষয় ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নেবেন দেশের খ্যাতিনামা কবি, সাহিত্যিক, প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিসহ সাংবাদিকবৃন্দ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।

আলোচনাসভা শেষে বিভিন্ন দলগত সংগীতা নুষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের খ্যাতিমান কণ্ঠ শিল্পীরা এখানে সংগীত পরিবেশন করবেন। প্রতিবারের ন্যায় মেলায় আগতদের মাঝে মেলা আকর্ষণীয় করে তুলতে মেলার উন্মুক্ত মঞ্চে কবিতা আবৃতি, নাটক, যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হবে।

এ ছাড়া মেলার মাঠে আনন্দ উপভোগের জন্য সার্কাস, ইজ্ঞিন ট্রেন, মৃত্যুকুপ, নাগোরদোলা, যাদু প্রদর্শনী, কৌতুকসহ বিভিন্ন বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া মেলার মাঠে বসেছে নানা ধরনের আকর্ষনীয় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মধুমেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি যশোর জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল মধুমেলা অশ্লীলতা মুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মধুমেলাতে সব কিছু শালীনতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করার জন্য কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

এদিকে বৃটিশ ভারতের প্রথম জেলা যশোরের কেশবপুরে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম ধন্যসাগরদাঁড়িতে মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি চলে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। ‘৮০ দশকে মধু কবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়ির ‘পৈত্রিক বসতবাড়ি’ প্রত্বতত্ত্ব অধিদপ্তর সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পরে কিছুটা ঘষামাজা করে পুরাতন জীর্ণশীর্ণ ভগ্নদশা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে কবির জন্মজয়ন্তী ও মধুমেলা উদ্বোধন কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাগরদাঁড়িতে পর্যটন কেন্দ্র ও মধুপল্লী গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। যার প্রেক্ষিতে পর্যটনের ১টি মধুপল্লী নির্মাণ করা হয়। যা এখানে আসা মধুপ্রেমীদের মনে দোলা তুলে স্মরন করিয়ে দেয় মধু কবির অতীত জীবন, সৃষ্টি ও স্মৃতিধন্য ইতিহাস ঐতিহ্যসহ এ এলাকার গৌরব গাঁথাকে।

স্বনামখ্যাত ঐতিহ্যবাহী যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করে ছিলেন বাংলা সাহিত্যের ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ, প্রাণের কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তকআধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সাগরদাঁড়ি গ্রামের স্থানীয় জমিদার পিতা রাজনারায়ন দত্ত আর মাতা জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে সোনার চামচ মুখেনিয়ে বাঙ্গালীর প্রিয় কবি এই পৃথিবীতে আর্বিভূত হন।

প্রাকৃতিক অপূর্ব লীলাভূমি, পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা, শষ্য সম্ভারে সম্বৃদ্ধ সাগরদাঁড়ি গ্রাম আর বাড়ির পাশে বয়ে চলাস্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের সাথে মিলেমিশে তার সুধা পান করে শিশু মধুসূদন ধীরে ধীরে শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে পরিনত যুবক হয়ে উঠেন। কপোতাক্ষ নদ আর মধুসূদন”দু’জনার মধ্যে গড়ে উঠে ভালবাসার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন।

মধুকবি ১৮২৪ সালে যখন জন্মগ্রহণ করেন সে সময়ে আজকের এই মৃত প্রায় কপোতাক্ষ নদ কাকের কালো চোখের মত স্বচ্ছ জলে কানায়কানায় পূর্ন আর হরদম জোঁয়ার ভাটায় ছিল পূর্ণযৌবনা। নদের প্রশস্ত বুক চিরে ভেসে যেত পাল তোলা সারি সারি নৌকার বহর আর মাঝির কন্ঠে শোনা যেত হরেক রকম প্রাণ উজাড় করাভাটিয়ালী ও মুর্শিদি গান। শিশু মধুসূদন এ সব অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখত আর মুগ্ধ হয়ে যেত।

স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের অবিশ্রান্ত ধারায় বয়ে চলা জলকে মায়ের দুধের সাথে তুলনা করেকবি তাই রচনা করলেন সেই বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদ’। তিনি লিখলেন- ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে’। ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের একপাঠশালায় মাওলানা লুৎফর রহমানের কাছে শিশু মধুসূদন তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন।

পাশাপাশি গৃহ শিক্ষক হরলাল রায়ের কাছে বাংলা ও ফারসি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু গাঁয়ের পাঠশালায় তিনি বেশি দিন শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। আইনজীবি পিতা রাজ নারায়ন দত্ত কর্মের জন্য পরিবার নিয়ে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকে ইংরেজী ভাষার প্রতি দূর্বল হয়ে পাড়ি জমান পশ্চিমা দেশ ফ্রান্সে। অবস্থান করেন ভার্সাই নগরীতে।

বিদেশী ভাষায় জ্ঞানার্জন করার পাশাপাশি এখানে বসেই তিনি রচনা করেন বাংলায় সনেট বা চর্তুদ্দশপদী কবিতা। সেখানে চলাফেরার এক পর্যায়ে মধুসূদন পর্যায়ক্রমে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে ভয়ংঙ্করভাবে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্থ ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ফিরে আসেন আবারো কলকাতায়। এ সময় তার পাশে ২য় স্ত্রী ফরাসি নাগরিক হেনরিয়েটা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার একটি হাসপাতালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পেছনে ফেলে রেখে যান একগুচ্ছ মনোকষ্ট আর অভিমান।

মহাকবির মৃত্যুর পর ১৮৯০ সালে মহাকবির ভাইয়ের মেয়ে মানকুমারি বসু সাগরদাঁড়িতে প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করেন। সেই থেকে শুরু হয় মধু জন্মজয়ন্তী ও মধুমেলার।

কেশবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ শাহিন জানান, অতীতের ন্যায় মেলাকে নিয়ে কোন বির্তকের সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। যে কোন উপায়ে মেলার সুশৃংঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসন বদ্ধ পরিকর।

মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিবও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মিজানূর রহমান বলেন, মেলায় মধুভক্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ও পাশাপাশি ডিবি, জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাথে প্রয়োজন মতো সাদা পোশাকে পুলিশ ও র‌্যাব-৬ বলবৎ থাকবে। এছাড়া মাঠে একাধিক নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ করা হবে। এছাড়া স্থানীয় ভাবেশতাধিক যুবকদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেচ্ছাসেবক বাহিনী।