মাছ নিয়ে কতো কথা, মাছে ভাতে বাঙ্গালি অতি প্রাচীন জনপ্রিয় আহার্য

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধিঃ আজ শনিবার (১৯ জানুয়ারী) মাছে ভাতে বাঙ্গালি নড়াইলে মাছ নিয়ে কতো কথা আমরা মাছ খাওয়া কবে শুরু হয়, তার কোনো সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই। তাই নড়াইলের হাওড়-বাঁওড়, আর খাল-বিল, নদী-নালার মাছ বোধহয় সেই আদিযুগ থেকেই খাওয়া হতো।

চন্দ্রকেতু গড়ে পাওয়া পোড়ামাটির ফলকে মাছ উত্তীর্ণ রয়েছে। ফলকটি গবেষকদের ধারণা চতুর্থ শতকের হতে পারে। অষ্টম শতাব্দী থেকে বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতিতে যেসব পোড়ামাটির ফলক মাটি খুঁড়েবের করা হয়েছে, তার বেশ কয়েকটিতে মাছের দৃশ্য দেখা যায়। কোনো কোনো মন্দির থেকে এমনকি বঁটি দিয়ে মাছ কোটা বাঙালি রমণীরদৃশ্যসংবলিত পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে।

মাছ যে বাঙালির একটা অতি প্রাচীন জনপ্রিয় আহার্য বস্তু, এ ফলকগুলো তারই পরিচায়ক।বঙ্গজীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মাছ আর মাছ। জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু পর্যন্ত সব জায়গায় কম-বেশি মাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়।

মুসলিমরা এদিক দিয়ে ভাগ্যবান, মত্স্যাহারে তিথি, সংক্রান্তি বা দিনক্ষণের কোনো বাধা বাঙালি মুসলমানের নেই। শুধু মিঠাপানির মাছই নয় সমুদ্রের মাছের স্বাদ গ্রহণে তাদের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বাঙালির মৎস্য প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায় আলপনায়, শাড়ির পাড়ে, আঁচলে, কানের দুলে, গলায় হারের নকশায় অথবা লকেটে।

বাঙালির মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে মাছের অনুপস্থিতি বিরল। বিয়েবাড়িতে, গায়ে হলুদে রুই মাছ সাজিয়ে পাঠানো শুভাশীষের প্রতীক। মাছ বাঙালির জন্য সুস্বাস্থ্যের ভাণ্ডার, প্রজনন শক্তির প্রতীক। বাঙালির সাহিত্যে মাছ সাঁতরে চলে। মঙ্গল কাব্যের পাতায় পাতায় মাছ রান্নার সৌরভম ম করে ভেসে বেড়ায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও মাছ ও মাছ ধরা জেলেজীবনের রয়েছে অনুপম চিত্রণ।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসের শুরুতেই সাত গাঁয়ের পুকুরের মাছ ধরার এক বিশাল বর্ণনা। রাজার গুরুলুইপাদ মাছের তেল, পেটি খেতে পছন্দ করেন। তাই ঘটা করে জাল ফেলে শয়েশয়ে মাছ ধরিয়ে ভাজা, চচ্চড়ি, ছেচকা, বড়ি এসব রাঁধালেন। গুরুলুইপাদ খেয়ে-দেয়ে শিষ্যকে আশীর্বাদ করলেন, ‘তোমার ধর্মে মতি হোক।’ (কল্যাণী দত্ত) রবীন্দ্রনাথ ইলিশ নিয়ে তেমন কিছু না লিখলেও মাছের কতপ্রসঙ্গ যে উপন্যাসে, ছড়ায়, কবিতায়, ছবিতে আর চিঠিপত্রে এনেছেন, তার শেষ নেই।

তিনি কবিতায় ‘দামোদর শেঠ কি’র সঙ্গে ‘ভেটকি’কে মিলিয়ে দিয়েছেন। চিতল মাছকে বলেছেন, মিঠাই গজার ছোট ভাই।‘নৌকাডুবি’তে খেতে বসে মাছের মুড়ো দেখে রমেশ কালিদাস আউড়ে বলেন, ‘স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, এ যে রুই মাছের মুড়ো বলেরোহিত মেস্যর উত্তমাঙ্গ।’

অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রমেশেরজবনীতে এ উচ্ছ্বাস প্রদান করেছেন। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরও রুই মাছবেজায় পছন্দ করতেন। তিনি তার আত্মজীবনী ‘তুজুক’-এ লিখে গেছেনযে, মালব থেকে গুজরাটে যেতে পথে সর্দার রায়সান তাকে একটা বড় রুইমাছ দেন। বহুদিন পর একটি ভালো রুই পেয়ে বাদশা এত খুশি হলেন যে, তখনই তিনি সর্দারকে একটি উতকৃষ্ট ঘোড়া উপহার দিলেন।

রুই মাছের কদর শরতচন্দ্রের লেখায়ও পাওয়া যাবে। মাছের মুড়ো একান্নবর্তী পরিবারে ক্ষমতা, স্নেহ, ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। শরতচন্দ্রের ‘মেজদিদি’তে হেমাঙ্গিনী যেই তার জার সতভাই কেষ্টকে আস্ত একটা রুই মাছের মুড়ো খেতে দিলেন, অমনি শুরু হয়ে গেল আশান্তি।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সমরেশ বসু, হরিশঙ্কর জলদাসের লেখার প্রতিপাদ্য কখনো কখনো জেলেদের জীবন। বাঙালির প্রবাদ-প্রবচনে, প্রতি দিনের কথায় মাছের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যের ছড়াছড়ি। আমরা যখন বলি অমুক ব্যক্তি সাক্ষাত রাঘব বোয়াল, তখন কী বলা হচ্ছে শ্রোতার বুঝতে দেরি হয় না। ঠিক তেমনি গভীর জলের মাছ, মাছের মা, মাছের তেলে মাছ ভাজা অথবা শাক দিয়ে মাছ ঢাকা কিংবা ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, মাছের মায়ের পুত্রশোক তখন আর টীকা-টিপ্পনীর দরকার হয় না।

শুধু কি দৈনন্দিন আটপৌরে ব্যবহারে মাছের উল্লেখ সীমাবদ্ধ, তা নয়। অরাজক পরিবেশের কারণে সৃষ্ট রাষ্ট্র বিপ্লবের পটভূমি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মৎস্যকুলের দৃষ্টান্ত বাংলার পাল রাজাদের তামার ফলকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মাৎস্যন্যায় শব্দটির সঙ্গে যারাই পরিচিত, তারা জানেন দেশে ঘোর অরাজক পরিস্থিতি বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয় বড় মাছ যখন ছোটমাছ খেয়ে ফেলে, তখনই বলা হয় মাৎস্য ন্যায়ের উদ্ভব হয়েছে।

অর্থাৎ অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাল রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের আবির্ভাবের প্রাক্কালে বাংলায় এমন অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করেছিল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মাছ উপখাত প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পায়নি। খাদ্যশস্য ও সবজি উৎপাদনে দেশ ঈর্ষণীয় উন্নতি লাভ করেছে। কিন্তু মাছের ক্ষেত্রে তেমন উন্নয়ন হয়নি।

এ কারণেই আমরা তীব্র মাছের অভাবে রয়েছি।বিগত দুই দশকে মাছ ধনী লোকদের খাবারে পরিণত হয়েছে। চলতি দশকে সাধারণ মানুষ মাছের স্বাদ চাহিদা অনুসারে কমই পেয়েছে। দেশের মানুষএ অবস্থার উত্তরণ প্রত্যাশা করে। এক সময় নড়াইল অঞ্চলের মানুষ মাছে-ভাতে বাঙালি বলে পরিচিত ছিল। আমরা আবার সেই পরিচিতি ফিরে পেতে চাই। সে জন্য মাছের প্রচুর সরবরাহ ও মূল্য সব মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকা প্রয়োজন।

বলা হয়ে থাকে কৃষি ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে জলাশয়ে মাছের রেণু মরে যায়। এ কারণেই পুকুর, খাল, বিল ওনদীতে পর্যাপ্ত মাছ জন্মে না। মাছ প্রাপ্তি উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধির জন্য কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রণালয় দুটি একীভূত করতে হবে। কৃষি ও মৎস্য উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নেই আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি পরিচিতি আবার ফিরে পেতে পারি।