দেদারসে চলছে গ্যাসের অবৈধ সরবরাহ

নোমান মাহমুদ, সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধিঃ নিয়ম অনুযায়ী সিএনজি ষ্টেশনের গ্যাস (রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) শুধুমাত্র যানবাহনে সরবরাহ করার কথা থাকলেও ঢাকার পার্শ্ববর্তী উপজেলা সাভারের সিএনজি স্টেশনগুলো থেকে অবৈধ ও ঝুর্কিপূর্ণ পদ্ধতিতে সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে আশেপাশের বিভিন্ন শিল্প ও কল-কারখানায়। এদিকে দিনের পর দিন বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন থেকে দেদারসে এই গ্যাসের অবৈধ সরবরাহ চলমান থাকলেও এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কারোও কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আর এতে করে যেকোন মূহুর্তে বড় ধরনের প্রানঘাতী দূর্ঘটনার আশংকা করছেন অনেকেই।

সরেজমিনে সাভারের বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, দিনব্যাপি খোলা ভ্যান, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহনে বিশেষ পদ্বতিতে স্থাপন করা সিলিন্ডারে গ্যাস (রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ করছে সিএনজি স্টেশনগুলো। এর একেকটি পায়ে ও ব্যাটারী চালিত খোলা ভ্যানে ৩ থেকে ৫টি সিলিন্ডার স্থাপন করা থাকলেও একেকটি কাভার্ড ভ্যানে স্থাপন করা হয় ৫০ থেকে ১৫০ টি সিলিন্ডার পর্যন্ত। বেশ কয়েকটি স্তরে কাভার্ড ভ্যানের ভিতরে সাজানো এই সিলিন্ডারগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করার পর তা চলে যায় আশেপাশের বিভিন্ন শিল্প ও কল-কারখানায়।

এদিকে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কাভার্ড ভ্যানে স্থাপন করা সিলিন্ডারে গ্যাস (রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উলাইল বাস স্টান্ড এলাকায় অবস্থিত সাভার সিএনজি এন্ড রিফুয়েলিং স্টেশনের ব্যবস্থাপক জহিরুল ইসলাম জানান, স্টেশনটির মালিক মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের অর্থ-সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম খান। মালিকের নির্দেশ মোতাবেকই এই গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এছাড়া মালিকের নির্দেশ থাকলেও অবৈধ এই কার্যক্রমের কারনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করে কিনা প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সব কিছু ম্যানেজ করেই এই গ্যাস দেওয়া হয়।”

এর আগে গত বছরের ৬ই সেপ্টেম্বর এই সিএনজি স্টেশন (সাভার সিএনজি এন্ড রিফুয়েলিং স্টেশন) থেকে একই পদ্ধতিতে অবৈধভাবে কাভার্ড ভ্যানে সিলিন্ডার স্থাপন করে গ্যাস সংগ্রহ করে তা কারখানায় ব্যবহারের অভিযোগে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ রাসেল হাসান কর্তৃক পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত সাভারের আল-মুসলিম গ্রুপকে নগদ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা ও সতর্ক করলেও অজ্ঞাত কারনে সেইসময়ও এই সিএনজি স্টেশনটিকে কোন প্রকার জরিমানা কিংবা বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

অন্যদিকে সিএনজি স্টেশন থেকে অবৈধ উপায়ে সিলিন্ডারে করে এই গ্যাস সরবরাহ ও পরিবহণ অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ উল্লেখ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের বিষ্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিষ্ফোরক পরিদর্শক মো. সামছুল আলম জানান, সিলিন্ডারে অবৈধভাবে এই গ্যাস পরিবহনে যে কোন মুহুর্তে মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর কোন কারনে এই সিলিন্ডার বিষ্ফোরিত হলে সিলিন্ডারের ধাতব অংশের আঘাতে ৫০০ গজের মধ্যে মানুষের মৃত্যু হওয়াসহ ১০০ গজের মধ্যে কোন মানুষ বা প্রানী থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যাবে।

তিনি বলেন, “সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাসের এই অবৈধ ও ঝুকিপূর্ণ সরবরাহ বন্ধে বিষ্ফোরক আইনে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য স্থানীয় জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্পষ্টভাবে ক্ষমতা দেওয়া আছে। তারা চাইলেই এগুলো বন্ধ করতে পারে। আমরা এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠিও দিয়েছি।”

এদিকে বিভিন্ন সিএনজি স্টেশনের এই অবৈধ কার্যক্রম প্রসঙ্গে আরপিজিসিএল (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড) এর মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, “সিএনজি স্টেশনের এইসব যাবতীয় কার্যক্রম সাধারনত স্থানীয় গ্যাস কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষন করেন। অনিয়ম পেলে তারাই এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন। আমাদের কাছে কোন অভিযোগ এলে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করে চিঠি দেই, তারপরেও যদি তারা সংশোধন না হয়, সেক্ষেত্রেতো সেইসব স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।” এসময় তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে খোজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহনেরও আশ্বাস দেন।

অন্যদিকে অবৈধভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস সংগ্রহ করে ব্যবহার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন স্বীকার করে তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক ব্যাবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ এর ডেপুটি সেক্রেটারি মোশাররফ হোসেন বলেন, “গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন পোশাক কারখানা কতৃপক্ষ বাধ্য হয়েই এইভাবে গ্যাস সংগ্রহ করে ব্যবহার করছেন। কেননা এছাড়াতো কোন উপায় নেই, ফ্যাক্টরিতো বাচিয়ে রাখতে হবে। এটা নিয়ে বিভিন্ন মালিকদের কাছ থেকে প্রস্তাব আসার পর আমরা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাথে কথা বলে এটাকে বৈধ করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কমিশন তা অনুমোদন দেয়নি। তাই ফ্যাক্টরি মালিকরা গোপনে পয়সা/টয়সা দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে। দেখা যায় খুব ভোর বেলা, কিংবা রাতে গোপনে তারা এই গ্যাসটা স্টেশন থেকে সংগ্রহ করছে। এটাতো সম্পুর্ন অবৈধ, অনেক সময় পুলিশও ধরে, ঝামেলা করে, তখন ঐ পয়সা/টয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে চলতে হয়।”

এদিকে ম্যানেজ করে চললেও ঝুকিপূর্ণ এই পদ্ধতিতে গ্যাস পরিবহন ও ব্যাবহারে কোন দূর্ঘটনা ঘটলে বিজিএমইএ এর দায় নিবে কিনা প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির ডেপুটি সেক্রেটারি মোশাররফ হোসেন বলেন, “না না, সংগঠন কিভাবে এর দায় নিতে পারে। এটাতো সম্পুর্ন অবৈধ। অবৈধ কার্যক্রমের দায় সংগঠন নিবে কেন। আমরা যখন অনুমোদন পাইনি, তখন সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সুতরাং অবৈধভাবে গ্যাস ব্যাবহারের কারনে কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়তো আমরা নিতে পারিনা।”

এই প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (সাভার আঞ্চল) উপ-মহাব্যবস্থাপক মোখলেসুর রহমান বলেন, “আমারদের দায়িত্ব মিটারে গ্যাস যাচ্ছে, মিটারে কোন কারচুপি হচ্ছে কিনা তা দেখা। এখন সেই গ্যাস কোথায় ব্যাবহার করা হচ্ছে, তা তো আর আমি বলতে পারবো না। এইটা দেখার জন্য বিষ্ফোরক অধিদপ্তর আছে। তারা এইটা দেখবেন।”

তবে প্রতিবেদকের নিকট সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাসের এই অবৈধ সরবরাহ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব তিতাসের নয় দাবি করলে গ্যাসের এই অবৈধ সরবরাহ বন্ধে তিতাস কর্তৃপক্ষ তাহলে ইতিপূর্বে কিভাবে বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন কতৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে জানতে চাইলে তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন, ” আগে পরে এইরকম কোন চিঠি দেওয়া হয়েছে কিনা তা আমার মনে পরছে না, এমন হতে পারে যে বিষ্ফোরক পরিদপ্তর আমাদের ব্যাবস্থা নিতে কোন চিঠি দিয়েছে, সেই আলোকে আমরাও সিএনজি স্টেশনকে চিঠি দিয়েছি।”