সড়ক-মহাসড়ক জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সিলিন্ডার বোমা

নোমান মাহমুদ, সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধিঃ একের পর এক আগুন ট্রাজেডি দেশের মানুষের স্বপ্নগুলোকে চোখের পলকে ভস্ম করে দিলেও, সর্বনাশা আগুনের হাত থেকে রেহাই পেতে অতীতের কোন অভিজ্ঞতাই দেশের মানুষকে আজ অবধি নিরাপদ করতে পারেনি।

২০১০ সালের ৩রা জুন পুরান ঢাকার নিমতলী ট্রাজেডি, ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন ট্রাজেডি, ২০১৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের ঘিওরে যাত্রীবাহী বাসের সিলিন্ডার বিষ্ফোরন, একই বছরের ১৪ই এপ্রিল আশুলিয়ার নয়ারহাট ডেল্টা সিএনজি স্টেশনে প্রাইভেট কারের সিলিন্ডার বিষ্ফোরনসহ সারাদেশে বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া ছোট-বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর সর্বশেষ গত ২১শে ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্ফোরনে চোখের পলকে অন্তসত্ত্বা নারী, শিশুসহ ৬৭ টি তাজা প্রানের ভস্ম হয়ে যাওয়ার পরেও আজও থামেনি এক শ্রেণীর স্বার্থলোভী বানিজ্যিক লুটেরাদের আগুনের সাথে সাপ-লুডু খেলা।

সুত্র বলছে বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত একটি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারে ১০০ পিএসআই এর কম চাপের গ্যাস থাকলেও একটি গাড়ির সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করা হয় ৩ থেকে ৪ হাজার পিএসআই চাপে। প্রচন্ড চাপে ভর্তি করা যানবাহনের এই গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপদ রাখতে তা নিয়মিত পরিক্ষা করাসহ তা ব্যাবহার ও পরিবহনে সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা।

তবে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সব নির্দেশনা উপেক্ষা করেই বিভিন্ন শিল্প ও কল-কারখানাসহ সিএনজি স্টেশনের অতিরিক্ত মুনাফালোভী মালিকদের বানিজ্যিক স্বার্থে প্রচন্ড চাপে ভর্তি করা এইসব রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) ভর্তি সিলিন্ডার যানবাহন ছাড়াই খোলা ভ্যানসহ বিভিন্ন ভাবে একেকটি বোমা হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে ঢাকাসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায়। আর অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণভাবে এই সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার পরিবহনের ভয়াবহতা অনুমান করে একের পর এক বিভিন্ন গণমাধ্যম এবিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করলেও তা বন্ধে জোরালো কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি কখনো। যদিও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চকবাজার ট্রাজেডির পর সরকারের পক্ষ থেকে যানবাহনে সিলিন্ডার ব্যাবহারের বিকল্প ভাবা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

তবে যানবাহনে সিলিন্ডার ব্যাবহারের বিকল্প ভাবা হলেও আইন অমান্য করে জনজীবন ঝুঁকির মধ্যে রেখে বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন থেকে অবৈধভাবে খোলা ভ্যানে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তি করে তা শিল্প-কারখানায় সরবরাহ ও ব্যাবহার বন্ধে এখনো কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি।

সরেজমিনে ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার, আশুলিয়া গাজিপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায় সিএনজি স্টেশনগুলোতে দিনভর বিভিন্ন খোলা ভ্যানসহ, কাভার্ড ভ্যানের ভিতর স্থাপন করা শত শত সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। আর এইসব গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার চলে যাচ্ছে আশেপাশের বিভিন্ন শিল্প কারখানায়। অথচ গ্যাস আইন ২০১০ অনুযায়ী সিএনজি স্টেশনের গ্যাস যানবাহন ব্যাতিত ভীন্ন কোথাও সরবরাহে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া বিষ্ফোরক আইনেও রয়েছে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা। তবে নিষেধাজ্ঞা কিংবা নীতিমালা যাই থাক, তা শুধুমাত্র কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের কোন জোড়ালো উদ্যোগ নেই।

এদিকে সিএনজি স্টেশন থেকে অবৈধ ও ঝুকিপূর্ণভাবে সিলিন্ডারে গ্যাস সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন পোশাক কারখানায় ব্যাবহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক ব্যাবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএ এর ডেপুটি সেক্রেটারি মোশাররফ হোসেন বিডি২৪রিপোর্ট’কে বলেন, “কারখানায় গ্যাসের চাপ কম থাকায় বাধ্য হয়েই বিভিন্ন কারখানা মালিকরা অবৈধ ভাবে সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে এই গ্যাস সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করছে।” তবে কারখানা বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে অবৈধ এই পদ্ধতিতে গ্যাস ব্যবহার করলেও, এর দ্বারা কোন দুর্ঘটনা ঘটলে বিজিএমইএ এর দায় নিবেনা বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি!

অন্যদিকে গ্যাসের এই অবৈধ সরবরাহ, পরিবহন ও ব্যাবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ন উল্লেখ করে বিষ্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিষ্ফোরক পরিদর্শক সামছুল হক বিডি২৪রিপোর্ট’কে বলেন, “এইসব অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে বিষ্ফোরক আইনেই স্পষ্টভাবে জেলা-উপজেলা প্রশাসনসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ক্ষমতা দেওয়া আছে। তারা চাইলেই এবিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারে।”

এছাড়া চলতি মাসে সাভারের উলাইল বাস স্টান্ড এলাকায় অবস্থিত সাভার সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন নামে একটি সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাসের অবৈধ সরবরাহ ও পরিবহনের বিষয় নিয়ে ঢাকার পার্শ্ববর্তী উপজেলা সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ রাসেল হাসানের সাথে কথা বললে তিনি প্রতিবেদককে এবিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। যদিও গত বছরের ৬ই সেপ্টেম্বর উপজেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে একই অভিযোগে সাভার সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস সংগ্রহ করে ব্যবহারের দায়ে সাভারের আল-মুসলিম গ্রুপ’কে নগদ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। তবে অজ্ঞাত কারনে সেই সময়ও গ্যাসের অবৈধ সরবরাহের দায়ে ঐ সিএনজি স্টেশনটিকে কোন প্রকার আর্থিক জরিমানা কিংবা তাদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করতে দেখা যায়নি।

শুধু সাভার সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনই নয়, অবৈধভাবে গ্যাস সরবরাহের এই দৃশ্য দেখা যায় সাভার উপজেলার প্রায় সবক’টি মিএনজি স্টেশনে।

অন্যদিকে সিএনজি স্টেশনের এই ঝুকিপূর্ণ অবৈধ কার্যক্রম দিনের পর দিন চলমান থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিল কিংবা শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহন না করে শুধুমাত্র সতর্ক করে চিঠি দেওয়ার মধ্য দিয়েই দায় সারছেন আরপিজিসিএল (রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানী লিঃ)। ব্যবস্থা গ্রহন প্রসঙ্গে আরপিজিসিএল এর মহা ব্যবস্থাপক (গ্যাস) মোঃ আলী বিডি২৪রিপোর্ট ‘কে বলেন, “কোন সিএনজি স্টেশনের বিরুদ্ধে এধরনের অভিযোগ এলে আমরা তাদের সতর্ক করে চিঠি দেই।” যদিও চিঠি পাওয়ার পরেও সতর্ক না হলে সেইসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি।

গ্যাসের অবৈধ সরবরাহে কোন সিএনজি স্টেশন কতটা লাভবান হচ্ছে কিংবা অবৈধভাবে এই গ্যাস ব্যবহার করে কোন শিল্প কারখানা বেঁচে থাকবে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই দেশের সাধারন মানুষের। সাধারন মানুষ তাদের নিরাপত্তা চায়। যাতে করে একের পর এক আগুন ট্রাজেডিতে ভস্ম হয়ে যাওয়া শত শত লাশের মিছিলে তার কিংবা তার স্বজনদের স্থান পেতে না হয়। যাতে করে আগুন ট্রাজেডি নিরাপদ মাতৃগর্ভকে কোন অনাগত সন্তানের জন্য অনিরাপদ না করে তোলে। আর তাই ফের কোন আগুন ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি হওয়ার আগেই সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ দেশের সড়ক-মহাসড়কে ঘুরে বেড়ানো এইসব অবৈধ সিলিন্ডার বোমার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবে সকলের এমনটাই প্রত্যাশা।