বনানীতে আগুন, সাহসী স্বর্নার কারণে বেঁচে গিয়েছিল ২৫ প্রান

রাজধানীর বনানীতে ভবনে লাগা আগুনে পুড়ে এবং ধোয়ার কারণে মারা গেছেন ২৬ জন। তবে সেই আগুন থেকেই বুদ্ধির জোরে বেঁচে ফিরেছেন সেঁজুতি স্বর্ণা। শুধু তাই নয়, তার বুদ্ধি আর সাহসীকতা বাঁচিয়ে দিয়েছে আরো ২০-২৫ জন মানুষের প্রান।

বাংলাদেশের একটি প্রথমসারির দৈনিককে নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন স্বর্না।

বনানীর এফ আর টাওয়ারে ১২ তলায় ডার্ড গ্রুপে ট্রেনিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত ছিলেন সেঁজুতি স্বর্ণা। এই বিল্ডিং এ ডার্ড গ্রুপের ১২, ১৩, ১৬ ও ১৯ তলায় মোট ৪টি অফিস রয়েছে। স্বর্ণা বলেন, দুপুর ১টার আগ পর্যন্ত আমরা একদমই বুঝতে পারিনি যে এতো ধোঁয়া এবং আগুন আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এর কিছুক্ষণ পরেই এডমিনের এক আপু বললেন আমাদের বিল্ডিং এ আগুন লেগেছে। তোমরা যে যেভাবে পারো নিজেদের মতো বের হয়ে ছাদের দিকে যাও।

আমরা ২৫ জনের মত ছিলাম। আমি আমার কাধের ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। দরজা পর্যন্ত কোন ভাবেই্ যেতে পারছিলাম না এতটাই উত্তাপ ছিল। আর সিঁড়িতে যাওয়া তো প্রশ্নই উঠে না। প্রচন্ড ধোঁয়ার কারণে ফিরে আসতে হয় আমাদের। এরমধ্যে আবার বিদ্যুতও চলে যায়।

প্রচণ্ড ধোঁয়ায় আমাদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমাদের ইমিডিয়েট বসকে বললাম স্যার আমরা রুমাল ও টাওয়াল ভিজিয়ে নাকে মুখে ধরলে নিঃশ্বাস নিতে সুবিধা হবে। পুরো বিল্ডিংটি গ্লাস প্রোটেক্টটেড। ফ্লোরের ধোঁয়া বের করতে আমরা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেই সমস্ত গ্লাসগুলো ভেঙ্গে ফেলবো। হাতের কাছে চেয়ার টেবিল যে যা পেয়েছি তাই দিয়ে গ্লাস ভাঙ্গার চেষ্টা করেছি। তবে গ্লাস ভাঙ্গতে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।

এ সময় সিনিয়র অনেকেই প্রাণে বাঁচতে লাফ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের বোঝালাম, যদি মরতে হয় এখানেই মরবো। কারণ এতো উঁচু থেকে লাফ দিয়ে বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপর কাগজে লিখে ভারি কিছুর সঙ্গে মুড়িয়ে নিচে ছুড়ে মারি। যেখানে লেখা ছিল, আমাদের জন্য অন্তত একটি সিঁড়ি পাঠান।

তখন মনে হলো মোবাইল ফোনে যেহেতু ইন্টারনেট আছে তাই লাইভ অথবা ভিডিও কিছু একটা করে ফেসবুকে দেই। অন্তত ফেসবুকের বন্ধুরা যে কেউ দেখে যেন ফায়ার সার্ভিসকে দেখায়। ভিডিওতে বলি ফায়ার সার্ভিসের লোকদের এই ভিডিওটা আপনারা একটু দেখান। না হলে আমরা কেউ সার্ভাইভ করতে পারবো না। ভাই আমাদের জন্য একটি সিঁড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ওই ভিডিও পাঠানোর অনেক পরে ৮ অথবা ১০ তলা পর্যন্ত ক্রেনে উঠে দুজন লোক আসে। তখন আমরা রিকোয়েস্ট করে বললাম প্লিজ আমাদের এখান থেকে বাঁচান।

তারা বলল দেখেন আগে আমাদের আগুন নিভাতে হবে। আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। ধোঁয়ার কারণে আমার ১ হাত সামনেও কোনো কিছু দেখতে পাইনি।

এতো ধোঁয়া ছিল যে আমরা ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলাম না। এমনকি চোখও খুলতে পারছিলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের গলা, চোখ, মুখ, স্কিনসহ সর্বত্রই জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেছে। রুমের মধ্যে প্রচণ্ড হিট। ১০ তলা পর্যন্ত উঠে আসা ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা বললো, দেখেন আমাদের ক্রেন ১২ তলা পর্যন্ত যাবে না। তখন আমরা মোটামুটি আশা ছেড়ে দিয়েছি যে আমরা হয়তো এ যাত্রায় আর বেঁচে ফিরবো না।

এ সময় ফ্লোরে অনেক সিনিয়র ভাইয়েরা ছিল যারা লাফ দেয়ার জন্য রেডি। তাদের বললাম ‘দেখেন যা হোক এখান থেকে হোক, আপনারা প্লিজ লাফ দিয়েন না’। যদি মরতে হয় এখানে থেকেও মরতে হবে। লাফ দিয়ে পড়েও মরতে হবে। কারণ লাফ দিলেও বাঁচার কোনো গ্যারান্টি নেই।

এর কিছুক্ষণ পরেই ল্যাডার নিয়ে দুজন ফায়ার সার্ভিসের লোক ১২ তলায় আসলো। আমরা অনুরোধ করে বললাম দেখেন ভাই মেয়েদের অন্তত আগে নামানোর ব্যবস্থা করেন। তখন এমন একটি পরিস্থিতি মেয়ে আর ছেলে কি সবাই বাঁচার জন্য আকুতি করছিল। ক্রেন বা ল্যাডারে ওঠার জন্য আমাদের যেখান থেকে লাফ দিতে হয়েছে সেটা কিন্তু যথেষ্ট নিচে ছিল। মেয়েদের পক্ষে এই উচ্চতাটা ম্যানেজ করে লাফ দেয়াটা অনেক কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

ক্রেনটি আসার পরে প্রথমেই লাফ দিয়ে দুই থেকে ৩টি ভাইয়া ও একজন আপু উঠে পড়লো। তখন আমি বললাম দেখেন আমি প্রেগনেন্ট। ধোঁয়ায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেকোনো মূল্যে আপনারা আমাকে এবং আমার অনাগত বাচ্চাটাকে বাঁচান। এটা আমার প্রথম বাচ্চা। তখন আমাকে তারা বললো প্লিজ আমাদের ১০ মিনিট সময় দেন। আমি বললাম ততোক্ষণ হয়তো আমার শ্বাস-প্রশ্বাস থাকবে না। অথবা আমি সার্ভাইভ করতে পারবো না।

ক্রেনের লোকদের নিচে নামিয়ে সর্বোচ্চ ৫ মিনিটের মধ্যে তারা আমাদের ফ্লোরে পৌঁছে যায়। এরপর বাকিদের নামানো হয়। আমরা সবাই আল্লাহর কৃপায় বেঁচে আছি। তবে ফ্লোরে আটকে পড়ে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা আমরা কীভাবে পার করেছি সেটা হয়তো কেউ মনে করতে পারবো না। সবচেয়ে খারাপ লেগেছে আমাদের অফিসের দারোয়ান ও পিয়ন এরা কখন বেরিয়ে গেছে কেউ টের পেলাম না। তাছাড়া আগুন লাগার পরে আমাদের ফ্লোরে কোনো এলার্মও বাজেনি। অফিসে অগ্নি নির্বাপক কোনো যন্ত্র ছিল না। ইমার্জেন্সি যে সিঁড়ি আছে সে সম্পর্কে আমাদের খুব একটা ধারণা নেই।

স্বর্ণার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ঢাকায় স্বামীর সঙ্গে পূর্ব রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় থাকেন। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন। বাবা মৃত শাহাজাদা। মা ওয়াসিমা আক্তার গৃহিণী। দুই ভাইবোনের মধ্যে স্বর্ণা বড়। স্বামী রাকিব কামাল ব্র্যাক ব্যাংকে কর্মরত।