হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বর্ণনায় ৭ আসমান

আজ বুধবার শাবান মাসের ১৪ তারিখ। এই দিনের আলো পেরিয়ে রাতের আঁধার নামলেই আবির্ভাব ঘটবে এক অলৌকিক অসামান্য মহাপুণ্যে ঘেরা রজনীর। এ রজনী মহাপবিত্র মহিমান্বিত লাইলাতুল মে’রাজের।

এ রাতে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম হযরত জিব্রাঈল (আ.) এর সাথে পবিত্র কাবা হতে ভূ-মধ্যসাগরের পূর্ব তীর ফিলিস্তিনে অবস্থিত পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস হয়ে সপ্তাকাশের উপর সিদরাতুল মুনতাহা হয়ে সত্তর হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে আজিমে মহান আল্লাহ তাআলার দিদার লাভ করেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তন করেন।

এদিকে সৃষ্টিজগত তথা মহাবিশ্ব ও সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক মহান আল্লাহ্ সুবাহানু ওয়া তা’য়ালা তার সর্বাধিক প্রিয়তম বন্ধু, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট মানব ও নবী-রাসুলগণের নেতা এবং সর্বশেষ পয়গম্বর হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে বিশ্বজগতের ক্ষণিক সময়ের মধ্যে স্বশরীরে পবিত্র কাবা হতে প্রথমে মসজিদে আকসা ও এরপর প্রথম আসমান হতে প্রতিটি আসমান হয়ে সপ্তম আসমান ও সর্বশেষ তার নিকটে ভ্রমণ করিয়েছেন।

যা আল্লাহ্ স্বয়ং পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্বর্গারোহণের এ মহাবিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে-

১। যখন আমি কাবাগৃহে উন্মুক্ত অংশ হাতীমে (উপনীত হলাম এবং তখনো আমি ভাঙা ঘুমে ভারাক্রান্ত) ঊর্ধ্বমুখী শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ এক আগন্তক ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) আমার নিকট আসলেন (এবং আমাকে নিকটবর্তী/ জমজম কূপের সন্নিকটে নিয়ে আসলেন)। অতঃপর আমার বক্ষে ঊধর্ব সীমা থেকে পেটের নিম্ন সীমা পর্যন্ত চিরে ফেললেন এবং আমার হৃৎপিণ্ড বা কল্বটাকে বের করলেন।

অতঃপর একটি স্বর্ণপাত্র উপস্থিত করা হলো, যা পরিপক্ব সত্যিকার জ্ঞানবর্ধক বস্তুতে পরিপূর্ণ ছিল। আমার কল্বটাকে (জমজমের পানিতে) ধৌত করে তাঁর ভিতরে ওই বস্তু ভরে কল্বটাকে নির্ধারিত স্থানে রেখে আমার বক্ষকে ঠিকঠাক করে দেয়া হলো। অতঃপর আমার জন্য খচ্চর হতে একটু ছোট, গাধা হতে একটু বড় শ্বেত বর্ণের একটি বাহন উপস্থিত করা হল তার নাম ‘বোরাক’, যার প্রতি পদক্ষেপ দৃষ্টির শেষ সীমায়। সেই বাহনের উপর আমাকে সওয়ার করা হলো।

২। ঘটনা প্রবাহের ভিতর দিয়ে জিবরাইল (আ.) আমাকে নিয়ে নিকটবর্তী তথা প্রথম আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। ভিতর হতে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলো, জিবরাইল স্বীয় পরিচয় প্রদান করলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার সঙ্গে কে? জিবরাইল বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। বলা হল, তাঁকে নিয়ে আসার জন্যই তো আপনাকে তাঁর নিকট পাঠান হয়েছিল? জিবরাইল বললেন- হ্যাঁ।

তারপর আমাদের অভিবাদন জানিয়ে গেট খোলা হলো। গেটের ভিতরে প্রবেশ করে তথায় আদম (আ.)-কে দেখতে পেলাম। জিবরাইল আমাকে তাঁর পরিচয় করে বললেন, তিনি আপনার আদিপিতা আদম (আ.), তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। আমার সালামের উত্তরে আমাকে ‘সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবী’ আখ্যায়িত করলেন এবং খোশ আমদেদ জানালেন।

৩। অতঃপর জিবরাইল আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছিলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। এখানেও পূর্বের ন্যায় কথোপকথন হলো এবং অভিবাদন জানিয়ে দরজা খোলা হলো। ভিতরে প্রবেশ করে তথায় ইয়াহইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেলাম; তাঁদের উভয়ের নানী পরস্পর ভগ্নী ছিলেন। জিবরাইল আমাকে তাঁদের পরিচয় দানে সালাম করতে বললেন, আমি তাঁদেরকে সালাম করলাম। তাঁরা আমার সালামের উত্তর প্রদান করলেন, বললেন ‘সুযোগ্য ভ্রাতা সুযোগ্য নবী’ বলে আমাকে খোশ আমদেদ জানালেন।

৪। অতঃপর জিবরাইল (আ.) আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানের দ্বারে পৌঁছলেন এবং গেট খুলতে বললেন। তথায়ও পূর্বের ন্যায় কথোপকথনের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানিয়ে দরজা খোলা হলো। ভিতরে প্রবেশ করে ইউসুফ (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেলাম। জিবরাইল (আ.) আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে সালাম করতে বললেন; আমি তাঁকে সালাম করলাম তিনি সালামের উত্তর দান করতঃ আমাকে ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে মোবারকবাদ জানালেন।

৫। অতঃপর আমাকে নিয়ে জিবরাইল চতুর্থ আসমানের নিকটে পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। সেখানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্নোত্তরের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানিয়ে গেট খোলা হলো। ভিতরে প্রবেশ করে আমরা তথায় ইদ্রিস (আ.) এর সাক্ষাৎ পেলাম। জিবরাইল (আ.) আমাকে তাঁর পরিচয় করিয়ে সালাম করতে বললেন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের উত্তর দিলেন এবং ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে আমাকে মারহাবা জানালেন।

৬। অতঃপর জিবরাইল আমাকে নিয়ে পঞ্চম আসমানে পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। এ স্থানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্নোত্তর চলার পর শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানানোর সঙ্গে দরজা খোলা হলো। আমি ভিতরে পৌঁছে হারুন (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেলাম জিবরাইল আমাকে তার পরিচয় দানে সালাম করতে বললেন। আমি সালাম করলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে আমাকে খোশ আমদেদ জানালেন।

৭। তারপর জিবরাইল আমাকে নিয়ে ষষ্ঠ আসমানের দরজায় পৌঁছলেন এবং দরজা খুলতে বললেন। এ স্থানেও পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে জিবরাইল স্বীয় পরিচয় দান করলেন, অতঃপর সঙ্গে কে আছে জিজ্ঞাস করা হলো। তিনি বললেন, মুহাম্মদ (সা.); বলা হলো, তাঁকে তো নিয়ে আসার জন্য আপনাকে পাঠানো হয়েছিল? জিবরাইল বললেন, হ্যাঁ। তৎক্ষণাৎ শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানিয়ে দরজা খোলা হলো। তথায় প্রবেশ করে মুসা (আ.)-এর সাক্ষাৎ পেলাম। জিবরাইল (আ:) আমাকে তাঁর পরিচয় জানিয়ে সালাম করতে বললেন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি সালামের উত্তর প্রদান করলেন এবং ‘সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবী’ বলে আমাকে মোবারকবাদ জানালেন।

৮। যখন আমি এই এলাকা ত্যাগ করে যাইতে লাগলাম তখন মুসা (আ.) কাঁদছিলেন। তাঁকে কাঁন্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আমি কাঁদছি এই কারণে যে, আমার উম্মতে বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা এই নবীর উম্মতের বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা অপেক্ষা কম হবে অথচ তিনি বয়সের দিক দিয়ে যুবক এবং দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছেন আমার পরে।

৮। এরপর জিবরাইল (আ.) আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানে আরোহণ করলেন এবং তার দ্বারে পৌঁছে দরজা খুলতে বললেন। এ স্থানেও পূর্বের ন্যায় সব প্রশ্নোত্তরের পর এবং দরজা খুলে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানান হলো। আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম। তথায় ইবরাহিম (আ.)-এর সাক্ষাৎ লাভ হলো। জিবরাইল আমাকে বললেন, তিনি আপনার (বংশের আদি) পিতা, তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম করলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং ‘সুযোগ্য পুত্র, সুযোগ্য নবী’ বলে মারহাবা ও মোবারকবাদ জানালেন।

৯। অতঃপর আমি সিদরাতুল মোনতার নিকট উপনীত হলাম। (তা এক বড় প্রকাণ্ড কূল বৃক্ষবিশেষ) তার এক একটা কুল হজর অঞ্চলে তৈয়ারি (বড় বড়) মটকার ন্যায় এবং তার পাতা হাতীর কানের ন্যায়। জিবরাইল আমাকে বললেন, এই বৃক্ষটির নাম ‘সিদরাতুল মুনতাহা’। তথায় চারটি প্রবাহমান নদী দেখতে পেলাম- দু’টি ভিতরের দিকে প্রবাহিত এবং দু’টি বাইরের দিকে। নদীগুলির নাম সম্পর্কে আমি জিবরাইলকে জিজ্ঞাসা করলাম।

তিনি বললেন, ভিতরের দু’টি বেহেশতে প্রবাহমান (সালসাবিল ও কাওসার নামক) দুইটি নদী। আর বাহিরের দিকে প্রবাহমান দু’টি হল (ভূ-পৃষ্ঠের মিসরে প্রবাহিত) নীল ও (ইরাকে প্রবাহিত) ফোরাত (নদী বা তাদের নামের মূল উৎস)। এরপর আমাকে “বায়তুল মা’মুর” পরিদর্শন করান হলো। তথায় প্রতিদিন (এবাদতের জন্য) সত্তর হাজার ফেরেশতা উপস্থিত হয়ে থাকেন (এ সত্তর হাজার ফেরেশতা দ্বিতীয়বারের জন্য আর কখনো এ সুযোগ পায় না)।

১০। অতঃপর (আমার সৃষ্টিগত স্বভাবের স্বচ্ছতা ও নির্মলতা প্রকাশ করে দেখাবার উদ্দেশ্যে পরীক্ষার জন্য) আমার সম্মুখে তিনটি পাত্র উপস্থিত করা হলো। একটিতে ছিল সুরা বা মদ, অপরটিতে ছিল দুধ, আরেকটিতে মধু। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাইল(আ.) বললেন, দুগ্ধ সত্য ও খাঁটি স্বভাবগত ধর্ম ইসলামের স্বরূপ; (সুতরাং, আপনি দুধের পাত্র গ্রহণ করে এটাই প্রমাণ করেছেন যে,) আপনি সত্য ও স্বভাবগত ধর্ম ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন এবং আপনার উসিলায় আপনার উম্মতও তার উপর থাকবে।