পুলিশ ঠেকাতে মাদক ব্যবসায়ীদের অভিনব কৌশল

নোমান মাহমুদ, সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধিঃ দেশব্যাপি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানের পর অনেকটাই কোনঠাসা হয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীরা। মাদক নিয়ন্ত্রনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়াশি অভিযানে বহু শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া ছাড়াও, কয়েক হাজার মাদক ব্যবসায়ীর ঠাই হয়েছে দেশের কারাগার গুলোতে। এর পরেও মাদকের সাথে জড়িত যেসকল অপরাধী পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধরাছোয়ার বাহিরে রয়ে গেছে, তারাও বিপাকে রয়েছে পুলিশের নিয়মিত তৎপরতায়।

এদিকে মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান অভিযানের মুখে অপরাধীরা যেমন মাদক পরিবহণের রুট বদলেছে, তেমনি বদলে নিয়েছে মাদক ব্যবসার কৌশলও। শুধু রুট কিংবা কৌশল নয়, নিজেদের রক্ষার্থে অভিনব কৌশল বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। এমনকি অভিযোগ রয়েছে, গ্রেপ্তার এড়াতে কখনো কখনো গণমাধ্যমেরও আশ্রয় নিচ্ছে অপরাধীরা।

সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী উপজেলা সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নে। পুলিশকে চাপের মুখে ফেলে গ্রেপ্তার ও বাড়িতে পুলিশি অভিযান এড়াতে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যম্যের কাছে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুটপাটের অভিযোগ করেছে এক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর পরিবার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) রাতে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের মোগড়াকান্দা এলাকায় মো. আবু বক্কর (৩৬) নামে এক ওয়ারেন্টভুক্ত (প্রসেস নং-৮৮২/১৯) চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করতে তার বাড়িতে অভিযান চালায় সাভার মডেল থানার ভাকুর্তা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই (উপ-পরিদর্শক) মো. তরিকুল ইসলাম। তবে ঐ রাতে বাড়িতে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে কৌশলে ঘরের জানালা খুলে পালিয়ে যায় ঐ মাদক ব্যবসায়ী। এদিকে মাদক ব্যবসায়ী পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ ঐ বাড়ি থেকে ফিরে আসার পরের দিন সকালে বাড়িতে পুলিশি অভিযানের কারন জানতে হাজ্বী আব্দুল বাতেন নামে স্থানীয় এক প্রতিবেশীর সাহায্য নেয় মাদক ব্যবসায়ী আবু বক্কর।

এবিষয়ে হাজ্বী আব্দুল বাতেন বিডি২৪রিপোর্ট’কে বলেন, “বুধবার সকালে আবু বক্কর আমার কাছে এসে জানায় যে রাতে তাকে গ্রেপ্তার করতে বাড়িতে পুলিশ এসেছিলো। এসময় আবু বক্কর তার সবগুলো মামলায় জামিনে আছে জানিয়ে ফাঁড়িতে খবর নিয়ে পুলিশ আসার কারন নিশ্চিৎ হতে অনুরোধ করলে আমি পুলিশের সাথে কথা বলি এবং একটি মামলায় আবু বক্করের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে বলে জানতে পারি। ওয়ারেন্টের বিষয়টি জানার পর আবু বক্কর এখান থেকে চলে যায়।”

এদিকে একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কথা জানার পর বাড়িতে পুলিশি অভিযান এড়াতে অভিনব কোশল বেছে নেয় মাদক ব্যবসায়ী আবু বক্কর ও তার পরিবার। স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকে খবর দিয়ে তাদের কাছে আবু বক্করের ছোট স্ত্রী অভিযোগ করে জানায়, পুলিশ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আবু বক্করকে না পেয়ে বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। এমনকি ঐ নারীর কানের দুল, বিভিন্ন স্বর্ণালংকারসহ ড্রয়ারে থাকা নগদ দেড় লক্ষ টাকা লুট করারও অভিযোগ আনা হয় পুলিশ কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

এদিকে মাদক ব্যবসায়ী আবু বক্করের স্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের অভিযোগ করলেও বিষয়টিকে হাস্যকর দাবি করে তারই প্রতিবেশী হাজ্বী আব্দুল বাতেন জানান, “ঘটনার পরদিন সকালে আবু বক্কর আমার কাছে এসেছিলো। এমন কিছু হলে সেসময় নিশ্চই সে আমাকে এবিষয়ে জানাতো। তাছাড়া বিষয়টি জানার পর আমি নিজে আবু বক্করের মায়ের সাথে কথা বলেছি। তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে সাংবাদিকদের এমন কিছু বলা হয়নি বলে জানিয়েছে। এছাড়াও মজার বিষয় হচ্ছে, আবু বক্করের ঘরে যদি দেড় লক্ষ টাকাই থাকবে তাহলে মাত্র দু’দিন আগে বক্করের বাবার কুলখানী অনুষ্ঠান করার জন্য সে আমার কাছ থেকে টাকা ধার নেবে কেন (?)।”

অন্যদিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে মাদক ব্যবসায়ী আবু বক্করের স্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের অভিযোগ করলেও আশ্চর্যজনকভাবে বিষয়টি অবগত নয় বলে জানায় মাদক ব্যবসায়ী আবু বক্কর।
আবু বক্কর পলাতক থাকায় বিডি২৪রিপোর্ট’এর পক্ষ থেকে বিষয়টি জানতে মুঠোফোনে তার সাথে কথা বললে তিনি জানান, পুলিশ বাড়িতে ভাংচুর কিংবা টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করেছে কিনা বিষয়টি তার জানা নেই। এদিকে বিষয়টি তার জানা না থাকলে তারই স্ত্রী কিভাবে গণমাধ্যমের কাছে এমন অভিযোগ করেছে এমন প্রশ্নেও তিনি প্রতিবেদককে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এমনকি বাড়িতে টাকা ছিলো কিনা কিংবা থাকলে সেই টাকার উৎস সম্পর্কেও প্রতিবেদককে কোন সদুত্তর দিতে পারেনি পলাতক মাদক ব্যবসায়ী আবু বক্কর।

এছাড়া বিষয়টি জানতে সরেজমিনে ঐ মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে গেলে বাড়ির কোন সদস্যই গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।

অপরদিকে অনুসন্ধানে মো. আবু বক্করের বিরুদ্ধে ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দায়ের হওয়া হত্যাসহ মোট ৭টি মামলার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে সাভার মডেল থানায় হত্যা, অস্ত্র ও মাদক সংক্রান্ত ৭টি মামলা এবং মিরপুর মডেল থানায় একটি মাদকের মামলা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আবু বক্করের বিরুদ্ধে সর্বশেষ মাদকের মামলাটি দায়ের হয় ২০১৮ সালের ১৮ই নভেম্বর। এছাড়া একই বছরের ১৮ই মার্চ তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অপর একটি মাদকের মামলায় আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

শুধু আবু বক্করই নয়, পুলিশ ঠেকাতে গণমাধ্যমের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা অভিযোগের কৌশল বেছে নিচ্ছে অনেক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরাই। গত কিছুদিন আগে সাভারের আমিনবাজার এলাকার সানোয়ার নামে কুখ্যাত এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করতে বাড়িতে পুলিশি অভিযানের পর পুলিশেরই এক সোর্সের মাধ্যমে নিজের আসল নাম-পরিচয় গোপন করে নিজেকে ব্যবসায়ী দাবি করে এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় একই রকম অভিযোগ তুলেছিলো পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী সানোয়ার ও তার পরিবার। তবে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে সানোয়ার নামে ঐ মাদক ব্যবসায়ীর আসল পরিচয় প্রকাশ হওয়ার পর সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে সে।

এদিকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে মাদক ব্যবসায়ীদের গণমাধ্যমকে ব্যবহারের এই অপকৌশলকে উদ্বেগজনক হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, কোন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর অভিযোগের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যকর্মীদের আরও সচেতন থাকা জরুরী। কোন অপরাধী যেন নিজেদের কু-কর্ম ঢাকতে গণমাধ্যমকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে না পারে সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এছাড়া অপরাধীদের এমন অপকৌশলের কারনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরতদের মনোবল ভাঙ্গার আশঙ্কাও করছেন তারা।

যদিও অপরাধীদের কোন অপকৌশলই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পিছু হটাতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সাভার মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ.এফ.এম সায়েদ। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “অপরাধীরা যত কৌশলই অবলম্বণ করুক, আমরাও প্রস্তুত আছি তাদের মোকাবেলা করতে।”