সিসিএস এর গোলটেবিল বৈঠকে এফডিএ’র মতো সংস্থার দাবি

নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন বা সংশোধনী নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্র এবং সিঙ্গাপুরের মতো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, বিশেষজ্ঞসহ সব স্টেকহোল্ডারকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘বাংলাদেশ সমন্বিত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে কনশাস কনজ্যুমার সোসাইটি (সিসিএস)।

আর সুপার শপের প্রতিনিধিরা বলছেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকারের কয়েকটি সংস্থার কাজে সমন্বয়ের অভাব আছে। তাই দায়িত্ব একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়া উচিত। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ’র (ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) আদলে একটি সংস্থা গঠনের প্রস্তাবে সায় দেন তারা।

শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিসিএস আয়োজিত ‘ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য : চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এই অভিমত ব্যক্ত করেন তারা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরে এম জাকির হোসেন খান বলেন, জনসাধারণের কাছে খাদ্যের গুণগত মান সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছায় না, যার ফলে তারা মানহীন খাদ্য ক্রয় করতে বাধ্য হয়। এছাড়া ভেজাল খাদ্য খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা অসুস্থ ভোক্তার সরাসরি মামলা দায়ের করার বিধান নেই। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয়, সহযোগিতার অভাব আছে।

এ সময় কিছু সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, নিরাপদ খাদ্যসংক্রান্ত সব ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং কনভেনশন মেনে চলার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে হবে। নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন বা সংশোধনী নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্র এবং সিঙ্গাপুরের মতো সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, বিশেষজ্ঞসহ সব অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশে সমন্বিত নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠনসহ খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও দ্রুত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা, আমদানি পণ্যগুলোর প্রবেশ মুখে পণ্যমান পরীক্ষা করে বাজারে ছাড়ার প্রস্তাব দেন পরিবেশ ও জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন বিষয়ক বিশ্লেষক এম জাকির হোসেন খান।

আলোচনায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে এখানে ৪-৫টি সংস্থা কাজ করে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর তো আছেই, এর বাইরে র‍্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে। এখানে আমার মনে হয় একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং অন্য সবাই কাজ করে, সেক্ষেত্রে কাজের সমন্বয় ভালো হতে পারে। কারণ, আমরা এখন সমন্বয়হীনতার মধ্যে কাজ করছি।

তিনি বলেন, আমাদের সবার সদিচ্ছা আছে। এই সদিচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে সিঙ্গেল ডাইমেনশনে কাজ না করলে সঠিক ফল পাওয়া যাবে না।

‘ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য : চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেওয়া অংশীজনদের একাংশ

এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, জনগণকে সচেতন করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, সাধারণ মানুষ অ্যানালাইসিস না করে সরল বিশ্বাসে পণ্য কেনেন। যখনই বিশ্বাসে ঘাটতি তৈরি হয়, তখন আর কিনতে চান না। এখানে প্রথম কাজটি সরকারের রেগুলেটরি বডির। তারা নিশ্চিত করবে যাতে খাদ্যে কোনও ভেজাল না আসে। আর এটা একমাত্র সম্ভব সুশাসনের মাধ্যমে।

তিনি আরও বলেন, ভেজাল আর নিম্নমান দুটি দুই জিনিস। চিনির সঙ্গে লবণ মেশালে সেটা ভেজাল আর লবণের আর্দ্রতার মাত্রা একটু বেশি বা কম থাকলে সেটা কিন্তু ভেজাল না। এটাকে আবার নিম্নমানও বলা যায় না। এগুলোকে সামাজিকমাধ্যমে আবার ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর মাধ্যমে আমরা নেগেটিভ ব্র্যান্ডিং করছি। একটা ব্র্যান্ড তৈরি করতে ২০-২৫ বছর সময় লাগে, এটাও কিন্তু এতো সহজ কাজ না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত বড় দেশেও কিন্তু এফডিএ’র মতো একটিমাত্র সংস্থা কাজ করে। কিন্তু, আমাদের এখানে অনেক সংস্থা।

চেইন সুপার শপ মীনা বাজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহীন খান বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে যা যা করা হচ্ছে এর ফাঁকে অনেক জিনিস বাদ পড়ে গেছে, যা কেউ দেখছে না। বিএসটিআই নির্দিষ্ট সংখ্যক পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা যদি সে কয়টি পণ্যের দিকে তাকাই, তাহলে কি তাদের মান সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? সেটা হয়ে থাকলে, সেই পণ্যে যখন ভেজাল পাওয়া যায়, তার জন্য কেন হাইকোর্টের নির্দেশ লাগবে পণ্যের উৎপাদন বন্ধ করতে? তার মানে ওই প্রতিষ্ঠানেও ভেজাল আছে যার কারণে ভেজাল পণ্যকে মার্কেট থেকে তুলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখছে না। আমার মনে হয় সর্বোপরি একটা প্রতিষ্ঠান দরকার, যদি সরকার সিরিয়াসলি নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে চায়। যেভাবে কাজটি হচ্ছে, এভাবে কাজটি করা যাবে না। একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের কাছে পরিষ্কার নয় তারা কীভাবে কাজ করেন।

স্বপ্ন সুপার শপের হেড অব সেলস শামসুদ্দোহা শিমুল বলেন, আমাদের সমস্যাটা হলো সুশাসনের জায়গায়। আমি বাইরে অনেক দেশেই দেখেছি যে সরকারের নিয়ন্ত্রণ একদম উৎপাদন পর্যায় থেকেই থাকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এখানে অনেক রেগুলেটরি বডি কাজ করছে, যে কারণে কাজের মধ্যে ভারসাম্য হারাচ্ছে।

আলোচনায় র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, আমি মনে করি আমরা যদি সবাই মিলে কাজ করি, উৎপাদন থেকে শুরু করে সমস্যাগুলোর প্রতি একটু মনোযোগ দেওয়া উচিত। আর একইসঙ্গে আমাদের দায়িত্বশীল যেসব সংস্থা আছে, তাদের ৫২টি নিম্নমানের পণ্যের বিষয়ে আরেকটু গভীরে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ, প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ল্যাব আছে। তাদের মান নিয়ন্ত্রক বিভাগ উপেক্ষা করে এই পণ্য বাজারে কীভাবে এলো? এখানে দায়ী কে ছিল? এই বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, সরকার ধরাধরির জায়গায় নয় বরং সরকার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পক্ষে। এই সরকার ব্যবসাবান্ধব সরকার। আমাদের সুপার শপগুলো এখন অনেক স্ট্যান্ডার্ড হয়ে গিয়েছে। আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এই কাজটি সমন্বিত ভাবে করতে হবে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, নানা পর্যায়ে আমাদের সক্ষমতার অভাব আছে। সক্ষমতা ছাড়া কর্তৃত্ব একটি সমস্যা হতে পারে। এই বাস্তবতার থেকে আমাদের উত্তরণ করতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের দায়িত্ব আছে, কিন্তু সেই দায়িত্ব আমাদের সক্ষমতা ছাড়া। তরুণদের বলবো এদিকে খুব বেশি নজর দিতে। এই দায়িত্ব নিজেরা নিতে চাচ্ছি, কিন্তু নিজেদের সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর আদলে একক সংস্থার ধারণার প্রয়োজন আছে। এখানে একক সংস্থার ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। এটা নিয়ে আলোচনা এবং এটা নিয়ে আগানো খুব প্রয়োজন। আবার ‘ওইটা না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা যাবে না’−ওই মানসিকতার মধ্যে ঢোকা যাবে না। বাংলাদেশে এটাও একটা সমস্যা, একটি কর্তৃপক্ষকে স্বাধীন হতে হবে। কেন সে একটা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে? ‘কর্তৃপক্ষ’ শব্দ ব্যবহার করছি, কিন্তু আমরা সেটায় স্বাধীনতা দিচ্ছি না। একক সংস্থাকে তার দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতা দিতে হবে। এফডিএ তাদের পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পায়, আমাদের সেই সুযোগ দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সঞ্চালনায় ছিলেন সিসিএস এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ। অনুষ্ঠান আয়োজনে সহায়তা করে ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ।

এতে আরও বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহকারী সম্পাদক সফিউল্লাহ আল মামুন, জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার প্রমুখ।