পাটকল আর রাষ্ট্রীয় খাতে চলবে না

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে পাটকলগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়। তখন মিলের সংখ্যা ছিল ৭৭। একটা সময়ে এসে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে সেগুলো একে একে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নিয়েই আওয়ামী লীগ সরকার বন্ধ দুই পাটকল চালু এবং বেসরকারীকরণ করা তিন পাটকল রাষ্ট্রীয় খাতে ফিরিয়ে এনে ফের চালু করে। কিন্তু এক দশক পর ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে আওয়ামী লীগ সরকারই সর্বশেষ ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে। মিলগুলো আর রাষ্ট্রীয় খাতে চালু না হওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্তও হয়েছে।

গত বছরের ২৮ জুন সংবাদ সম্মেলন করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সব পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত জানান বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তখন বলা হয়েছিল, এগুলো পরবর্তী সময়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় চলবে। এখন শোনা যাচ্ছে, বেসরকারি উদ্যোক্তার কাছে লিজ দিয়ে মিলগুলো ফের চালু করা হবে।

সর্বশেষ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ছিল ২৫টি। স্থায়ী শ্রমিক ছিল ২৪ হাজার ৮৮৬ জন। তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিকভিত্তিক শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ হাজার। শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসর দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। তবে তাঁদের সবার পাওনা এখনো পরিশোধ করা হয়নি। পাওনা পরিশোধ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে পুনরায় মিল পরিচালনার দাবিতে খুলনার খালিশপুর এলাকার শ্রমিকরা আন্দোলন করছিলেন। সম্প্রতি কলোনি ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকারনামা নিয়ে বেশির ভাগ শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। তবে বদলি বা অস্থায়ী শ্রমিকরা কিছুই পাননি। এখন মিলগুলোর শ্রমিক কলোনি প্রায় ফাঁকা।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পাটকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে তারা পাটকলগুলো লাভজনক করার শর্তে বিজেএমসিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকাও দিয়েছিল। এমনকি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া কয়েকটি কারখানা আবার ফিরিয়ে নিয়ে চালু করেছিল সরকার। ২০১০-১১ অর্থবছরে বিজেএমসি সাড়ে ১৭ কোটি টাকা লাভ করে। কিন্তু এরপর আবার শুরু হয় লোকসানের পর্ব। গত এক দশকেই রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। আর এই লোকসানের যুক্তিতেই পাটকলগুলো সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

বেসরকারি খাতে পাট : সরকারি পাটকল বন্ধের প্রক্রিয়ার মধ্যেই ১৯৮৪ সালে বেসরকারি পাটকলের যাত্রা শুরু হয়। এখন বেসরকারি খাতে স্পিনিং মিলসহ দুই শর বেশি পাটকল আছে। এই মিলগুলো লাভ করছে। তবে এর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে যেসব বেসরকারি মালিককে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের অনেকেই সেগুলো কম মূল্যে নিয়ে যন্ত্রপাতি ও মিল এলাকার অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে টাকা নিয়ে সরে পড়েছেন।

নাগরিকদের সংগঠন পাট ও পাটশিল্প রক্ষা কমিটির সম্পাদক খালিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলো বন্ধ করে তা বেসরকারি খাতে বিক্রি বা লিজ দিয়ে চালানোর অর্থ সাধারণের সম্পত্তি ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া। এতে শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। এর আগে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া পাটকলগুলোর সম্পদ বিক্রি করে বেসরকারি মালিকরা লাভবান হয়েছে; মিল বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, মিল যথাযথভাবে চালাননি, শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন। যেসব পাটকল বেসরকারি উদ্যোক্তারা লিজ নিয়েছিল সেগুলোও চলেনি।

লোকসানের দায় শ্রমিকের : রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের পাটকলগুলো লোকসানের জন্য বরাবরই শ্রমিকদের বাড়তি মজুরিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন বিজেএমসির কর্তারা। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় গত জুনে বলেছিল, বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি দুই হাজার ৭০০ টাকা। আর সরকারি পাটকলগুলোতে মজুরি আট হাজার ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বাজারে টিকে থাকতে কম দামে পাটপণ্য বিক্রি করতে হয়।

অবশ্য শ্রমিক নেতারা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। শ্রমিক নেতা মোজাম্মেল হক হাওলাদার বলেন, সরকারি পাটকলের যন্ত্রপাতি ৬০-৭০ বছরের পুরনো। ফলে পাটকলের উৎপাদনক্ষমতা ৪০-৪৫ শতাংশে নেমে যায়। তা ছাড়া পাটের মৌসুমে সুলভ মূল্যে কাঁচা পাট না কিনে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনাটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। এটি লোকসানের একটি বড় কারণ।