অপরাধ জগতের পরিচিত দুই খুনির আরও যত অপকর্ম

গতকাল বুধবার সকাল ১০টার দিকে স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নয়ন নামে এক যুবকের নেতৃত্বে ৪-৫ দুর্বৃত্ত রিফাতকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।

এ সময় তার রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় চিকিৎসক বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। আর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাল ৪টার দিকে রিফাত মারা যান। রিফাত বরগুনার বুড়িরচর ইউনিয়নের মাইঠা গ্রামের দুলাল ফরাজীর একমাত্র ছেলে।

বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে এলে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে বরগুনা পৌরসভার ধানসিঁড়ি সড়কের আবু বকর সিদ্দিকের ছেলে নয়ন বন্ড এবং তার প্রতিবেশী দুলাল ফরাজীর ছেলে রিফাত ফরাজী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বুধবার সকাল ১০টার দিকে নয়ন নামে এক যুবকের নেতৃত্বে ৪-৫ জন সন্ত্রাসী রিফাতকে দা দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যায়। এ সময় বারবার সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।

কিন্তু যে দুই যুবক এই হত্যালীলা চালালেন, তারা কারা? এ প্রশ্ন এখন দেশবাসীর। সবাই জানতে চাচ্ছেন, এদের শক্তির উৎস কী? স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকারী দুই জনের একজন রিফাত ফরাজী। আরেকজনের নাম নয়ন (২৫) বন্ড। তারা দুইজনই অনেক আগে থেকেই অপরাধ জগতের পরিচিত মুখ। তাদের কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।

রিফাত ফরাজী বিষয়ে স্থানীয় ও ভুক্তভোগী এলাকাবাসীরা জানান, মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিলেন রিফাত ফরাজী। ফলে স্থানীয়দের কাছে একটি আতঙ্কের নাম রিফাত ফরাজী। রিফাতের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। প্রতিবেশী ও স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর রিফাতের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

জানা গেছে, এসব কারণে কয়েকবার গ্রেফতার হলেও অজ্ঞাত এক কারণে খুব স্বল্প সময়েই মুক্তি পান তিনি। ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক যখম করেন রিফাত ফরাজী।

এ বিষয়ে তরিকুল জানান, একদিন সামান্য কথা কাটাকাটি হয় রিফাত ফরাজীর সঙ্গে তার। তখন রিফাত ফরাজী তাকে কুপিয়ে যখম করার হুমকি দেন। রিফাত ফরাজীর ভয়ে তিনি দেড় মাস রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে তার বাসায় যাওয়া আসা করতেন। হুমকি দেয়ার দেড় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে তরিকুল তার বাসায় যাওয়ার পথে রিফাত ফরাজী দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তার মাথায় গুরুতর যখম করেন। এ ঘটনায় তরিকুলের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।

একই বছর বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডিকেপি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে বাসায় থাকা সব ছাত্রদের জিম্মি করে, তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যায় রিফাত ফরাজী। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করেন।

এ ঘটনার বিষয়ে ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ছেলে ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ‘ডিকেপি রোডের আমাদের ভাড়া দেয়া বরগুনা পলিট্যাকনিক ইনিস্টিটিউটের মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করেন রিফাত ফরাজী। এ ঘটনা জানার পর আমি বরগুনা সদর থানায় গিয়ে অভিযোগ করায় রিফাত ফরাজীর বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরে তিনি রিফাতের কাছ থেকে ছিনতাই করা ১৪টি মোবাইলের মধ্যে ১১টি উদ্ধার করেন। আর বাকি তিনটি মোবাইল উদ্ধার করতে না পেরে নতুন মোবাইল কিনে দিয়ে থানা থেকে মুক্তি পান।’

এ ছাড়া বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা মারজানা মনি বলেন, ‘২০১৭ সালের রমজানে আমার একমাত্র ছোট ভাই হাফেজ মো. মেহেদী হাসান বরগুনার হোমিও চিকিৎসক আলাউদ্দিন ডাক্তারের বাসা সংলগ্ন মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ায়। তখন রিফাত ফরাজী একদিন মেহেদীর কাছ থেকে স্যামস্যাং গ্যালাক্সি কোর প্রাইম মডেলের বিদেশ থেকে আনা একটি ফোন ছিনিয়ে নেন। বিষয়টি রিফাত ফরাজীর মা-বাবাসহ স্থানীয় অনেককে জানানোর পরও আমার ভাইয়ের মোবাইলটি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারেনি। পরে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করার পর সাড়ে সাত হাজার টাকার বিনিময়ে মোবাইলটি ফিরিয়ে দিয়ে হুমকি দেন রিফাত ফরাজী। পরে রিফাত ফরাজীর হুমকিতে ওই এলাকা ছেড়ে একপ্রকার পালিয়ে আসে আমার ভাই।’

অন্যদিকে, নয়ন বন্ড হচ্ছে বরগুনা সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে বরগুনা পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দ।। নয়নের বাবা মৃত ছিদ্দিকুর রহমান। দুই ভাইয়ের মধ্যে নয়ন ছোট। নয়নের বড় ভাই মিরাজ দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুর প্রবাসী হওয়ার কারণে মাকে নিয়েই ওই বাসায় বসবাস করছেন নয়ন। বরগুনা সদর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগী ইমামের বিরুদ্ধে। পরে তাদের জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসেন নয়ন বন্ড। জেল থেকেই বেরিয়ে মূলত এ হত্যাকাণ্ড ঘটান তিনি।

বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে নয়ন বন্ডের বাসায় অভিযান চালায়। এ সময় বিপুল পরিমাণ মাদক, দুটি দেশীয় অস্ত্র ও এক সহযোগীসহ নয়ন বন্ডকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসব মাদকের মধ্যে ছিল ৩০০ পিস ইয়াবা, ১২ বোতল ফেনসিডিল ও ১০০ গ্রাম হেরোইন।

বিষয়টি নিয়ে বরগুনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবীর হোসেন মাহমুদ বলেন, নয়ন বন্ডের মাদক বাণিজ্যের কথা আমরা জানি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলাসহ একাধিক মামলার কথাও আমরা জেনেছি। এর আগে নয়ন ও তার সহযোগী জেল খেটেছে। জামিনে তারা বেরিয়ে যায়। রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়নসহ সবাইকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।