ঢাকা , শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ৩০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
বিচারকের বাসায় হা’ম’লা, ছু’রিকা’ঘাতে ছেলে নি’হত: হা’মলা’কারী বিএনপি নেতার ছেলে ধানের শীষের প্রার্থীকে রেখে নেতাকর্মীরাই খেয়ে ফেললেন সব খাবার পুণেতে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ নিহত, ১৫ আহত; আগুনে পুড়ে গেছে ট্রাক রাজশাহীতে ধানের শীষ সমর্থক নারী নেতা ও তার বোনকে হামলার অভিযোগ, বিএনপির সংবাদ সম্মেলন আসন সমঝোতায় অচলাবস্থা: জমিয়তের ১২ আসন দাবি, বিএনপি রাজি মাত্র ৫টিতে দেবীদ্বার আসনে লড়বেন এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বাংলাদেশ-পাকিস্তানের আত্মিক বন্ধন অটুট: ফজলুর রহমান তোমাদের আপা আর আসবে না, আ.লীগকে লায়ন ফারুক জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিএনপিতে যোগদান: বিএনপির মিথ্যা সংবাদের প্রতিবাদ জানালো জামায়াত এনসিপি এলে ৪০, না এলে ২৩ আসনে সমঝোতা করবে বিএনপি

অমুসলিমদের সথে মহানবী (সা.)-এর আচরণ যেমন ছিলো

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট সময় ০১:৫৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর ২০২৫
  • ১৫৬ বার পড়া হয়েছে

 

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, যা মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্কের পাশাপাশি অমুসলিমদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রেও ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিস্তৃত নির্দেশনা প্রদান করে। কোরআন ও হাদিসে মুসলমানদের অমুসলিমদের সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কসহ সব ধরনের সম্পর্কের বিষয়ে দিকনির্দেশনা আছে।

 

 

এর কারণ হলো, ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম। এটি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে।

 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে রাসুল) বলুন, হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৮)

 

 

যে ধর্মের বার্তা সমগ্র মানবজাতি এবং তাদের সব শ্রেণির উদ্দেশে প্রেরিত, যে ধর্ম পৃথিবীর সব মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির প্রতিনিধি হয়ে এসেছে, তা কোনো গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ বা শত্রুতার শিক্ষা দিতে পারে না। ইসলাম তার আকিদা ও বাণী প্রচারের জন্য কোনো ধরনের জবরদস্তি বা জোর-জুলুমের পথ অবলম্বনকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে।

 

ইসলাম সম্পর্ক স্থাপনে সত্যবাদিতা, নম্রতা, বিনয়, কোমলতা, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা এবং ন্যায়-ইনসাফের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার ওপর জোর দিয়েছে।

 

 

পাশাপাশি মিথ্যাচার, প্রতারণা, রূঢ় আচরণ, ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা এবং অশান্তি সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছে। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামের এই নির্দেশনা শুধু মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য নয়, বরং মুসলমান ও অমুসলিম উভয়ের সঙ্গেই এসব গুণ অনুসরণের নির্দেশ দেয়।

 

অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কের মূলনীতি

 

 

ইসলাম তার অনুসারীদের অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহনশীলতা ও উদারতার ওপর গুরুত্বারোপ করে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রত্যেক মানুষই তার মানবিক মর্যাদার কারণে সম্মানিত, সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন এবং তার গায়ের রং বা জাতি যা-ই হোক না কেন।

 

ইসলাম ধর্ম মতে, এই পৃথিবী মানবজাতির জন্য এক পরীক্ষার ক্ষেত্র। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে সঠিক পথ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার স্বাধীনতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছি, এখন সে কৃতজ্ঞ হবে বা অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা : আদ-দাহর, আয়াত : ৩)

 

মানুষের মুসলিম বা অমুসলিম হওয়া আল্লাহর এক বিশেষ হিকমত। তিনি ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সব মানুষকে মুসলিম বানিয়ে দিতে পারতেন।

 

কিন্তু তার ইচ্ছা ও প্রজ্ঞা হলো, প্রত্যেককে তার নিজের পছন্দমতো ধর্ম অনুসরণ করার অধিকার দেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আপনার রব চাইলে সব মানুষকে একই পথের অনুসারী বানিয়ে দিতেন কিন্তু (কাউকে জোর করে কোনো দ্বিন মানতে বাধ্য করাটা তাঁর হিকমতের পরিপন্থী। তাই তাদেরকে তাদের ইচ্ছাক্রমে যেকোনো পথ অবলম্বনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে) তারা বিভিন্ন পথেই চলতে থাকবে।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১৮)

 

যেহেতু কারো মুসলিম বা অমুসলিম হওয়া আল্লাহর ইচ্ছার অংশ, তাই ইসলাম জোর করে কাউকে মুসলিম বানানোর অনুমতি দেয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সব মানুষ ঈমান আনত। তবে আপনি কি মানুষকে বাধ্য করবেন যেন তারা ঈমান নিয়ে আসে?’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৯৯)

 

ইসলাম সব মানুষের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ দেয়। এটি এমন একটি ধর্ম, যা তার অনুসারীদের, তা সে মুসলিম বা অমুসলিমের সঙ্গেই হোক, কখনোই অন্যায় বা অবিচার করতে নিষেধ করে। ইসলামে জুলুম ও অধিকার হরণের কোনো স্থান নেই। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মজলুম-নিপীড়িত ব্যক্তির দোয়া—সে যদি কাফিরও হয়, তার ও আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না। (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪১১, হাদিস : ২৩৫৩৬)

 

অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রকারভেদ

 

অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রকারভেদ নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা সম্পর্কের তিনটি শ্রেণি বর্ণনা করেছেন—

 

১. মুওয়ালাত : মুওয়ালাত বলতে অন্তরের গভীর ভালোবাসা ও হৃদয়ের সখ্যকে বোঝানো হয়। এটি শুধু মুসলমানদের মধ্যে বৈধ এবং সহধর্মীদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ। কাফির ও মুশরিকদের সঙ্গে গোপনীয় সম্পর্ক স্থাপন করা, তাদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা রাখা বা এমন কোনো সম্মান প্রদর্শন করা, যা কুফর ও শিরকের প্রতি শ্রদ্ধার সমতুল্য হয়, এটি ইসলামী দৃষ্টিকোণে বৈধ নয়। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ, খণ্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১৯৫)

 

কোরআনের বহু আয়াত এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে কুফর ও শিরক গ্রহণকারীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বা আপস করার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এগুলো মূলত মুওয়ালাত সম্পর্কিত নির্দেশ। (তাফসিরে রাজি, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-১৪)

 

২. মুওয়াসাত : মুওয়াসাত অর্থ সহানুভূতি, কল্যাণকামিতা এবং উপকার সাধন। এমন অমুসলিম যারা মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না বা শত্রুতায় লিপ্ত নয়, তারা সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতার যোগ্য। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রদর্শন করা এবং তাদের কল্যাণ কামনা করা বৈধ। এর ফলে অমুসলিমরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং মুসলমানদের সদ্ব্যবহার ও সুন্দর আচরণ দেখে মুগ্ধ হবে। এতে পারস্পরিক দূরত্ব কমবে এবং সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে। (বয়ানুল কুরআন, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২০৪)

 

৩. মুদারাত : মুদারাত বলতে সদাচরণ ও নম্র ব্যবহারকে বোঝানো হয়। এটি সব ধরনের অমুসলিমের সঙ্গে বৈধ। বিশেষত, যখন এর উদ্দেশ্য হয় ধর্মীয় কল্যাণ সাধন, ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো বা ইসলামের নৈতিকতার পরিচয় দেওয়া। এ ছাড়া যদি তারা অতিথি হয়, তবে অতিথির সম্মান জানানো প্রত্যেকের কর্তব্য। আবার কখনো কখনো এর উদ্দেশ্য তাদের ক্ষতি বা দুশ্চরিত্র থেকে নিরাপদ থাকা হতে পারে। (আল-জামে লি আহকামিল কোরআন, খণ্ড-১২, পৃষ্ঠা-৪৩৫)

 

কোরআনের বিভিন্ন আয়াত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন থেকে প্রমাণিত হয় যে একজন মানুষ, সে অমুসলিম হলেও তার কিছু মৌলিক মানবিক অধিকার রয়েছে। যেমন—জীবনযাপনের অধিকার, অর্থনৈতিক সংগ্রামের অধিকার, সম্পদ ও সম্পত্তির মালিকানা এবং তা ব্যবহার করার অধিকার ইত্যাদি। ইসলাম তাদের জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা সুরক্ষার শিক্ষা দেয় এবং মানবতার প্রতি এই মৌলিক অধিকারগুলোকে সম্মান করার নির্দেশনা দেয়।

 

নবীজীবনের আলোকে অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক

 

ইসলাম শুধু অমুসলিমদের সঙ্গে সহনশীলতা, উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশই দেয় না, বরং ইসলাম এই গুণাবলিকে শুধু পছন্দনীয় নয়, বরং সওয়াব ও পুরস্কারের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবনবৃত্তান্তে, বিশেষত তায়েফ সফর, বিভিন্ন যুদ্ধ এবং মক্কা বিজয়ের ঘটনাবলিতে এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়, যা উজ্জ্বল উদাহরণে পরিপূর্ণ, যার তুলনা ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর এগুলো এমন পরিস্থিতিতে ঘটেছিল, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন এবং তাদের পক্ষ থেকে সর্বদা ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।

 

সাধারণত এমন সংকটময় অবস্থায় মানুষ উত্তম আচরণ বা সহমর্মিতার পথ থেকে সরে যায়, কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই সময়েও মানবতার প্রতি সম্মান বজায় রেখেছিলেন। এটাই ইসলামী শিক্ষার মূল সৌন্দর্য, যা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও উত্তম চরিত্র ও সহনশীলতার ওপর জোর দেয় এবং কখনো অমুসলিমের প্রতি অবজ্ঞা বা বিদ্বেষ প্রদর্শন করে না। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা-৫৭)

 

তাই একজন মুসলমানের উচিত ইসলামের এই শিক্ষাগুলোকে তার জীবনযাপনের অংশ করা এবং অমুসলিমদের প্রতি সদয় আচরণ করা। এভাবেই ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো দূর করা সম্ভব এবং ইসলামোফোবিয়ার মতো অপপ্রচারের মোকাবেলা করা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার ও মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ট্যাগস

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বিচারকের বাসায় হা’ম’লা, ছু’রিকা’ঘাতে ছেলে নি’হত: হা’মলা’কারী বিএনপি নেতার ছেলে

অমুসলিমদের সথে মহানবী (সা.)-এর আচরণ যেমন ছিলো

আপডেট সময় ০১:৫৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ নভেম্বর ২০২৫

 

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, যা মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্কের পাশাপাশি অমুসলিমদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রেও ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিস্তৃত নির্দেশনা প্রদান করে। কোরআন ও হাদিসে মুসলমানদের অমুসলিমদের সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কসহ সব ধরনের সম্পর্কের বিষয়ে দিকনির্দেশনা আছে।

 

 

এর কারণ হলো, ইসলাম একটি সর্বজনীন ধর্ম। এটি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে।

 

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে রাসুল) বলুন, হে মানুষ, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর প্রেরিত রাসুল, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৫৮)

 

 

যে ধর্মের বার্তা সমগ্র মানবজাতি এবং তাদের সব শ্রেণির উদ্দেশে প্রেরিত, যে ধর্ম পৃথিবীর সব মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির প্রতিনিধি হয়ে এসেছে, তা কোনো গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ বা শত্রুতার শিক্ষা দিতে পারে না। ইসলাম তার আকিদা ও বাণী প্রচারের জন্য কোনো ধরনের জবরদস্তি বা জোর-জুলুমের পথ অবলম্বনকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে।

 

ইসলাম সম্পর্ক স্থাপনে সত্যবাদিতা, নম্রতা, বিনয়, কোমলতা, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা এবং ন্যায়-ইনসাফের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার ওপর জোর দিয়েছে।

 

 

পাশাপাশি মিথ্যাচার, প্রতারণা, রূঢ় আচরণ, ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা এবং অশান্তি সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছে। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইসলামের এই নির্দেশনা শুধু মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য নয়, বরং মুসলমান ও অমুসলিম উভয়ের সঙ্গেই এসব গুণ অনুসরণের নির্দেশ দেয়।

 

অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কের মূলনীতি

 

 

ইসলাম তার অনুসারীদের অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহনশীলতা ও উদারতার ওপর গুরুত্বারোপ করে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রত্যেক মানুষই তার মানবিক মর্যাদার কারণে সম্মানিত, সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন এবং তার গায়ের রং বা জাতি যা-ই হোক না কেন।

 

ইসলাম ধর্ম মতে, এই পৃথিবী মানবজাতির জন্য এক পরীক্ষার ক্ষেত্র। আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে সঠিক পথ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার স্বাধীনতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরা তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিয়েছি, এখন সে কৃতজ্ঞ হবে বা অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা : আদ-দাহর, আয়াত : ৩)

 

মানুষের মুসলিম বা অমুসলিম হওয়া আল্লাহর এক বিশেষ হিকমত। তিনি ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সব মানুষকে মুসলিম বানিয়ে দিতে পারতেন।

 

কিন্তু তার ইচ্ছা ও প্রজ্ঞা হলো, প্রত্যেককে তার নিজের পছন্দমতো ধর্ম অনুসরণ করার অধিকার দেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আপনার রব চাইলে সব মানুষকে একই পথের অনুসারী বানিয়ে দিতেন কিন্তু (কাউকে জোর করে কোনো দ্বিন মানতে বাধ্য করাটা তাঁর হিকমতের পরিপন্থী। তাই তাদেরকে তাদের ইচ্ছাক্রমে যেকোনো পথ অবলম্বনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে) তারা বিভিন্ন পথেই চলতে থাকবে।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১৮)

 

যেহেতু কারো মুসলিম বা অমুসলিম হওয়া আল্লাহর ইচ্ছার অংশ, তাই ইসলাম জোর করে কাউকে মুসলিম বানানোর অনুমতি দেয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীর সব মানুষ ঈমান আনত। তবে আপনি কি মানুষকে বাধ্য করবেন যেন তারা ঈমান নিয়ে আসে?’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৯৯)

 

ইসলাম সব মানুষের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ দেয়। এটি এমন একটি ধর্ম, যা তার অনুসারীদের, তা সে মুসলিম বা অমুসলিমের সঙ্গেই হোক, কখনোই অন্যায় বা অবিচার করতে নিষেধ করে। ইসলামে জুলুম ও অধিকার হরণের কোনো স্থান নেই। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মজলুম-নিপীড়িত ব্যক্তির দোয়া—সে যদি কাফিরও হয়, তার ও আল্লাহর মধ্যে কোনো পর্দা থাকে না। (মুসনাদে আহমদ, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৪১১, হাদিস : ২৩৫৩৬)

 

অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রকারভেদ

 

অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রকারভেদ নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা সম্পর্কের তিনটি শ্রেণি বর্ণনা করেছেন—

 

১. মুওয়ালাত : মুওয়ালাত বলতে অন্তরের গভীর ভালোবাসা ও হৃদয়ের সখ্যকে বোঝানো হয়। এটি শুধু মুসলমানদের মধ্যে বৈধ এবং সহধর্মীদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ। কাফির ও মুশরিকদের সঙ্গে গোপনীয় সম্পর্ক স্থাপন করা, তাদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা রাখা বা এমন কোনো সম্মান প্রদর্শন করা, যা কুফর ও শিরকের প্রতি শ্রদ্ধার সমতুল্য হয়, এটি ইসলামী দৃষ্টিকোণে বৈধ নয়। (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ, খণ্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১৯৫)

 

কোরআনের বহু আয়াত এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে কুফর ও শিরক গ্রহণকারীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বা আপস করার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এগুলো মূলত মুওয়ালাত সম্পর্কিত নির্দেশ। (তাফসিরে রাজি, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-১৪)

 

২. মুওয়াসাত : মুওয়াসাত অর্থ সহানুভূতি, কল্যাণকামিতা এবং উপকার সাধন। এমন অমুসলিম যারা মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না বা শত্রুতায় লিপ্ত নয়, তারা সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতার যোগ্য। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা, দুঃখ-কষ্টে সহানুভূতি প্রদর্শন করা এবং তাদের কল্যাণ কামনা করা বৈধ। এর ফলে অমুসলিমরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং মুসলমানদের সদ্ব্যবহার ও সুন্দর আচরণ দেখে মুগ্ধ হবে। এতে পারস্পরিক দূরত্ব কমবে এবং সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পাবে। (বয়ানুল কুরআন, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-২০৪)

 

৩. মুদারাত : মুদারাত বলতে সদাচরণ ও নম্র ব্যবহারকে বোঝানো হয়। এটি সব ধরনের অমুসলিমের সঙ্গে বৈধ। বিশেষত, যখন এর উদ্দেশ্য হয় ধর্মীয় কল্যাণ সাধন, ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো বা ইসলামের নৈতিকতার পরিচয় দেওয়া। এ ছাড়া যদি তারা অতিথি হয়, তবে অতিথির সম্মান জানানো প্রত্যেকের কর্তব্য। আবার কখনো কখনো এর উদ্দেশ্য তাদের ক্ষতি বা দুশ্চরিত্র থেকে নিরাপদ থাকা হতে পারে। (আল-জামে লি আহকামিল কোরআন, খণ্ড-১২, পৃষ্ঠা-৪৩৫)

 

কোরআনের বিভিন্ন আয়াত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস এবং সাহাবায়ে কিরামের জীবন থেকে প্রমাণিত হয় যে একজন মানুষ, সে অমুসলিম হলেও তার কিছু মৌলিক মানবিক অধিকার রয়েছে। যেমন—জীবনযাপনের অধিকার, অর্থনৈতিক সংগ্রামের অধিকার, সম্পদ ও সম্পত্তির মালিকানা এবং তা ব্যবহার করার অধিকার ইত্যাদি। ইসলাম তাদের জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা সুরক্ষার শিক্ষা দেয় এবং মানবতার প্রতি এই মৌলিক অধিকারগুলোকে সম্মান করার নির্দেশনা দেয়।

 

নবীজীবনের আলোকে অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক

 

ইসলাম শুধু অমুসলিমদের সঙ্গে সহনশীলতা, উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশই দেয় না, বরং ইসলাম এই গুণাবলিকে শুধু পছন্দনীয় নয়, বরং সওয়াব ও পুরস্কারের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবনবৃত্তান্তে, বিশেষত তায়েফ সফর, বিভিন্ন যুদ্ধ এবং মক্কা বিজয়ের ঘটনাবলিতে এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়, যা উজ্জ্বল উদাহরণে পরিপূর্ণ, যার তুলনা ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর এগুলো এমন পরিস্থিতিতে ঘটেছিল, যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মুশরিকদের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন এবং তাদের পক্ষ থেকে সর্বদা ক্ষতির আশঙ্কা ছিল।

 

সাধারণত এমন সংকটময় অবস্থায় মানুষ উত্তম আচরণ বা সহমর্মিতার পথ থেকে সরে যায়, কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই সময়েও মানবতার প্রতি সম্মান বজায় রেখেছিলেন। এটাই ইসলামী শিক্ষার মূল সৌন্দর্য, যা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও উত্তম চরিত্র ও সহনশীলতার ওপর জোর দেয় এবং কখনো অমুসলিমের প্রতি অবজ্ঞা বা বিদ্বেষ প্রদর্শন করে না। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা-৫৭)

 

তাই একজন মুসলমানের উচিত ইসলামের এই শিক্ষাগুলোকে তার জীবনযাপনের অংশ করা এবং অমুসলিমদের প্রতি সদয় আচরণ করা। এভাবেই ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণাগুলো দূর করা সম্ভব এবং ইসলামোফোবিয়ার মতো অপপ্রচারের মোকাবেলা করা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার ও মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।