১৯৬৭ সালের ৫ জুন যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা মাত্র ছয় দিনে আরব বিশ্বের অহংকার চূর্ণ করে দিয়েছিল। মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের সম্মিলিত শক্তিকে বিধ্বস্ত করে ইসরায়েল কেবল সিনাই, গাজা, পশ্চিম তীর বা গোলান মালভূমিই দখল করেনি, কেড়ে নিয়েছিল আরব জাতীয়তাবাদের আত্মবিশ্বাস। কিন্তু ঠিক ৫৮ বছর পর, ২০২৫ সালের জুনে, ইতিহাস যেন এক নতুন প্রতিধ্বনির মুখোমুখি। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ সপ্তম দিনে গড়িয়েছে এবং এবার ১৯৬৭-এর মতো দ্রুত পতন ঘটেনি, বরং একাই লড়ে যাচ্ছে ইরান।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধ ছিল ইসরায়েলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব, দ্রুতগতির বিমান হামলা আর পশ্চিমা সমর্থনের এক নিখুঁত প্রদর্শনী। কিন্তু ২০২৫-এর বাস্তবতা ভিন্ন। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান নিজেকে ইসরায়েলের ঘোর শত্রু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। “ইসরায়েল ধ্বংস হোক”—এই স্লোগানকে ভিত্তি করে তারা হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, যা ইসরায়েল সবসময়ই নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে, ২০২৫ সালের ১৩ জুন, ইসরায়েল যখন ইরানের ভেতরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে দেশটির শীর্ষ সামরিক ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করে, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন এটি হবে আরেকটি ছয় দিনের যুদ্ধ। ধারণা ছিল, ইসরায়েলের ‘সারপ্রাইজ অ্যাটাক’ ইরানকে শুরুতেই পঙ্গু করে দেবে। কিন্তু যুদ্ধের সপ্তম দিনেও ইরান কেবল দাঁড়িয়েই নেই, বরং পাল্টা আঘাত হানছে। ইসরায়েলের হাইফা, তেলআবিবসহ বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি ও পারমাণবিক স্থাপনার আশেপাশে একাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তারা—যা ১৯৬৭-এর আরব দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ইরানকে “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের” আহ্বান জানান, তখন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির জবাব ছিল স্পষ্ট: “ইরানিরা আত্মসমর্পণের জাতি নয়।” তার এই বক্তব্য শুধু ইরানের নয়, বরং কয়েক দশকের আরব-ইসলামি বিশ্বের পরাজয় ও লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক উচ্চারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশ্ন হলো, ইরান কি তবে জয়ী হচ্ছে? সামরিক অর্থে হয়তো এখনই তা বলা যাবে না। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক শক্তি এখনও সীমিত, আর বিপরীতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা গোয়েন্দা জোট। কিন্তু যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের হিসাব নয়; মনোবল, ইতিহাস ও রাজনৈতিক বার্তারও মঞ্চ। সেই মঞ্চে ইরান ইতোমধ্যে এমন কিছু অর্জন করেছে, যা অনেক আরব দেশ কয়েক দশকেও পারেনি।
তারা প্রমাণ করেছে, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ সম্ভব। এই লড়াই যেন আরব বিশ্বের অসমাপ্ত আক্ষেপ আর ঐতিহাসিক অপমানের এক প্রতিশোধ হয়ে উঠেছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং চূড়ান্ত বিজয় হয়তো ইরানের অধরা থাকবে। তবে ইতিহাসে হয়তো লেখা থাকবে: “যখন কেউ ভেবেছিল ইতিহাস আবারও ছয় দিনে লিখে ফেলা যাবে, তখন একজন দাঁড়িয়ে বলেছিল—এইবার নয়।”