বাংলাদেশের কৃষি এখন আর শুধু জীবিকার উৎস নয়; এটি রূপ নিয়েছে এক গবেষণানির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায়। মাঠে কৃষকের ঘাম আর গবেষণাগারে বিজ্ঞানীর মেধার সমন্বয়ে কৃষি আজ জাতীয় অর্থনীতির এক শক্তিশালী স্তম্ভ—যাকে বলা যায় ‘কৃষি অর্থনীতি’।
কৃষিবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী চিন্তা ও নিরলস পরিশ্রমে ফসলের নতুন জাত, আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি, গবাদিপশু উন্নয়ন পদ্ধতি, দুধ ও মাংসের মানোন্নয়ন, এমনকি মৎস্যচাষেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তারা রেখেছেন যুগান্তকারী অবদান। এসব উদ্ভাবনের ফলেই পুনর্গঠিত হয়েছে কৃষকের অর্থনৈতিক ভিত্তি—গবেষণার প্রভাব এখন কেবল কাগজে নয়, মানুষের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন এনেছে।
বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১১ শতাংশ হলেও কর্মসংস্থানে এর অংশ ৪১ শতাংশেরও বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, কৃষির উন্নতির কারণেই গত এক দশকে অতিদারিদ্র্যের হার ৪৯ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে মাত্র ১০.৫ শতাংশে। স্বাধীনতার পর দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি টনে। জনসংখ্যা আড়াই গুণ বৃদ্ধি ও আবাদযোগ্য জমি এক-চতুর্থাংশ কমে যাওয়ার পরও উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ—এটাই কৃষি গবেষণার সবচেয়ে বড় সাফল্য।
এই বিপ্লবের মূল নেপথ্যে রয়েছে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের (NARS) ১৪টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তারা এখন পর্যন্ত ৯৭২টি উচ্চ ফলনশীল ও ঘাতসহনশীল ফসলের জাত এবং ১,৩৯২টি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি কেবল খাদ্য নিরাপত্তাই নয়; পুষ্টি, আয় ও কর্মসংস্থানেরও সমাধান দিয়েছে। বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ ও চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং পাট রপ্তানিতে প্রথম স্থানে রয়েছে।
তবে এই সাফল্যের মাঝেও রয়েছে কিছু উদ্বেগজনক বাস্তবতা। অনেক তরুণ কৃষিবিদ পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন, কর্মরত গবেষকরাও বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকছেন। অথচ কৃষি গবেষণা শুধু অফিসকেন্দ্রিক কাজ নয়—এটি মাঠে, ল্যাবে, কৃষকের পাশে এক নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের নাম। তাই কৃষি গবেষণাকে বিশেষায়িত সার্ভিস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং গবেষকদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় কৃষির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন থমকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আমরা প্রায়ই গবেষণাকে ব্যয় হিসেবে দেখি, কিন্তু এটি আসলে জাতির ভবিষ্যতের বিনিয়োগ। উন্নত দেশগুলো গবেষণাকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ মনে করে, যার ফলেই তারা অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে আছে। গবেষণার মানদণ্ড যদি উদ্ভাবনের মাত্রা, সামাজিক প্রভাব ও ব্যবহারযোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়, তবে গবেষকরা আরও উৎসাহিত হবেন।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রয়োজন কৃষিকে আরও উৎপাদনমুখী ও বাণিজ্যিকীকরণযোগ্য করে তোলা। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব, কৃষি ইপিজেড গঠন এবং পূর্ণাঙ্গ যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য।
বাংলাদেশের কৃষি আজ বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির প্রতীক। যারা এই বিপ্লবের নেপথ্যে আছেন—সেই কৃষিবিজ্ঞানীরা—তাদের প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা জরুরি। গবেষণায় বিনিয়োগকে ব্যয় নয়, ভবিষ্যতের পুঁজি হিসেবে দেখতে হবে। উন্নত দেশে গবেষক মানেই জাতির সম্পদ; বাংলাদেশেও সেই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলাই সময়ের দাবি।
ড. মো. আল-মামুন
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা

ডেস্ক রিপোর্ট 

























